উপরওয়ালার কৃপায় বরফ পড়া দেখতে পাব কি না জানা ছিল না। তবে রেলের প্রভুর কৃপায় ট্রেনের টিকিট কনফার্মড ছিল চার মাস আগে থেকে। ১২৩১১ আপ হাওড়া-দিল্লি-কালকা মেল। স্লিপার ক্লাস, মাথা পিছু ৬৮০ টাকা। আমরা দুই, আমাদের দুই। ২ খুদের একজন ১২-র ওপরে, একজন নীচে। এখন খুদেদের বয়স ১২-র ওপরে হলে বড়দের মতো পুরো ভাড়া। ১২-র নীচে হলে অর্ধেক ভাড়ায় টিকিট মিলবে, কিন্তু রাতে শোয়ার বার্থ মিলবে না। প্রত্যেকের আলাদা বার্থ নিতে চাইলে ৫ বছরের ওপর হলেই পুরো ভাড়া।


গন্তব্য কালকা হয়ে সিমলা-কুলু-মানালি।

কলকাতা থেকে সিমলা যাওয়া যায় অনেক ভাবে। কিন্তু ৩৩ ঘণ্টা ট্রেন জার্নি করে কালকা হয়ে যাওয়ার একমাত্র আকর্ষণ ছিল কালকা-সিমলা রুটের শতাব্দী ক্লাস শিবালিক ডিলাক্স এক্সপ্রেস। ভারতের অন্যান্য পাহাড়ি রেলওয়ের সঙ্গে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা পেয়েছে কালকা-সিমলা রেলপথও। ২০০৮ সাল থেকে এই মুকুট তার মাথায়।

কালকা-র টিকিট আগে কেটে রাখলেও শিবালিক-এর টিকিট কাটতে দেরি হয়েছিল। ফলে, ২টো কনফার্মড-এর পাশাপাশি ২টো ওয়েটিং ছিল। ওয়েটিং লিস্ট ১ ও ২। কনফার্মড হবে তো? চিন্তা একটু ছিল। তবে বেশি চিন্তায় রেখেছিল কালকা মেল। কারণ, নানা কারণে ক’দিন ধরে বেশ কয়েক ঘণ্টা দেরিতে যাতায়াত করছিল সে। শিবালিক এক্সপ্রেস হচ্ছে কালকা মেলের কানেক্টিং ট্রেন। সন্ধে ৭টা ৪০-এ ছেড়ে আপ কালকা মেল-এর কালকা পৌছনোর কথা তৃতীয় দিন ভোর ৪টে ৩০-এ। শিবালিক-এর কালকা ছাড়ার কথা সকাল ৫টা ২০-তে। আপ কালকা মেল দেরি করে পৌঁছলে দেরি করে ছাড়ে শিবালিক। কিন্তু কতটা দেরি করে হেরিটেজ ট্রেন? ইন্টারনেট ঘেঁটে নম্বর জোগাড় করে একদিন ফোন করে বসলাম কালকার স্টেশন ম্যানেজারকে। বললেন, কালকা মেল ১-২ ঘণ্টা দেরি করলে অপেক্ষা করে শিবালিক। তার বেশি নয়।

ওয়েটিং লিস্টে থাকা শিবালিকের দু’টি টিকিটই কনফার্মড হল। চিন্তা কাটল। কিন্তু কালকার বিলম্বিত লয় আর ঠিক হল না! রওনা হওয়ার দিন দুপুরে ১৩৯-এ এসএমএস করতেই উত্তর এল, আপ কালকা মেল ৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট লেট! ছাড়বে রাত ২টোয়!!

রাত ২টোতেই ছাড়ল ট্রেন। শুরুর ৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট লেট বাড়তে বাড়তে রাস্তায় দাঁড়াল ১৭ ঘণ্টায়! যে দিন ভোর সাড়ে ৪টেয় আমাদের পৌঁছনোর কথা কালকায়, হিসেব করে দেখলাম, ওইদিন রাত সাড়ে ৯টার আগে পৌঁছনো অসম্ভব। কোনও উপায় না দেখে, ট্রেনে বসেই শিবালিকের টিকিট ক্যানসেল করে পরের দিন ভোরের টিকিট কাটলাম। মাথাপিছু ৪২০ টাকা। হিসেব মতোই কালকা পৌছলাম তৃতীয় দিন রাত ৯টা ৩৫-এ। ১৭ ঘণ্টা ৫ মিনিট লেট! অগত্যা রেলওয়ে ক্যান্টিনের ভাত-ডাল-তরকারি খেয়ে কালকা স্টেশনের ওয়েটিং রুমে রাত্রিবাস।

ভোর ৫টা। স্টেশনে দাঁড়িয়ে শিবালিক।

আমাদের টিকিট সি-২ কামরায়। ইঞ্জিনের পর সি-১, তারপর সি-২। টিকিট কাটার সময় থেকেই সিট নম্বর থাকে। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার আগে অ্যাটেন্ডেন্ট-এর সঙ্গে কথা বলে সিট পছন্দ বা নিজের ইচ্ছে মতো দিকে ঘুরিয়ে নেওয়া যায়। শতাব্দী শ্রেণির শিবালিক চেয়ার কার। মিটার গেজ লাইন। ছোট কামরা। দু’পাশে দু’টি করে গদি মোড়া চেয়ার। কার্পেট মোড়া মেঝে। বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য বিশাল বিশাল কাচের জানালা। জানালায় সুদৃশ্য পর্দা।



ছাড়ার কথা, ৫টা ২০-তে। শিবালিক ছাড়ল ৫ মিনিট দেরিতে। বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যায় না। অন্ধকারেই পাহাড়ের বাঁক ঘুরে ঘুরে সাপের মতো বেঁকে বেঁকে ওপরে উঠতে শুরু করল হেরিটেজ ট্রেন। আমাদের সিট ছিল ডান দিকে, জানালার ধারে। যখনই বাঁক ঘুরছিল শিবালিক, তখনই সামনের কামরা থেকে পিছনের কামরাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। অন্ধকারের মধ্যে আলো জ্বলা কামরাগুলিকে অদ্ভুত লাগছিল! একটা কথা, শিবালিকে চড়লে, ডান দিকের সিটে বসার চেষ্টা করবেন। কারণ, পুরো যাত্রাপথে জানালার ডান দিকেই সরে সরে যাবে চোখ জুড়োন পাহাড়।

কালকা ও সিমলার মাঝে ১৬টি স্টেশন। টাকশাল, গুম্মান, কোটি, সোনওয়ারা, ধরমপুর, কুমারহাটি, ব্যারগ, সোলান, সালোকরা, কান্দাঘাট, কানোহ, কাঠলিঘাট, সোঘি, তারাদেবী, জুটোঘ ও সামারহিল। কিন্তু ৯৬ কিলোমিটার যাত্রাপথে একটিমাত্র স্টেশনেই থামে শিবালিক। ব্যারগ-এ। কালকা থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরের ওই স্টেশন থেকেই যাত্রীদের জন্য সকালের খাবার তোলা হয়। কালকা থেকে সিমলা যাওয়ার পথে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয় যাত্রীদের। সিমলা থেকে কালকা ফেরার পথে ডিনার। ট্রেন ছাড়ার একটু পরে অ্যাটেন্ডেন্ট এসে জেনে গেলেন, আমরা ভেজ না নন ভেজ।

ক্রমেই পাহাড়ে উঠছে শিবালিক। ওই দিনের কালকা মেল তখনও না আসায় যাত্রী সংখ্যা কম। বেশ কয়েকটা আসন খালি। যাঁর যেখানে পছন্দ সেখানে গিয়ে বসছেন। মজা করছেন। কিন্তু সূর্য না ওঠায় তখনও বাইরেটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে, একটার পর একটা সুড়ঙ্গ পেরিয়ে চলেছে টয় ট্রেন। দার্জিলিঙের টয় ট্রেনে এখনও চড়া হয়নি। সিমলা যাওয়ার পথে আবছা আলোয় বেশ টের পাচ্ছিলাম খেলনা ট্রেনের মজা!

কালকা-সিমলা রেল লাইন পাতার সময় পাহাড়ের দু’প্রান্ত থেকে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়র কর্ণেল ব্যারগ সুড়ঙ্গ খোঁড়া শুরু করেন। কিন্তু হিসেবের ভুলে দু’টি রাস্তাকে মেলাতে পারেননি। ইংরেজ সরকারের নির্দেশে তাঁকে ১ টাকা জরিমানা দিতে হয়। লজ্জায়, অপমানে ওই অসম্পূর্ণ সুড়ঙ্গের মধ্যেই আত্মহত্যা করেন কর্ণেল ব্যারগ। ওই এলাকাতেই সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। পরে মুখ্য ইঞ্জিনিয়র এইচ এস হ্যারিংটন, ভালকু নামে স্থানীয় এক সাধুর সাহায্যে সুড়ঙ্গ শেষ করার কাজ হাতে নেন ১৯০০ সালে। কাজ শেষ হয় ১৯০৩-এ। খরচ হয় ৮ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু কর্ণেল ব্যারগের নামেই নাম হয় এলাকার। মজার ব্যাপার, এই রূটের ২০ টি ছোট ছোট স্টেশনের প্রত্যেকটিই কোনও না কোনও সেতুর কাছাকাছি। আসলে সেতু তৈরির সময় শ্রমিকদের বিশ্রামের জন্য যে ছাউনিগুলি তৈরি হয়েছিল, সেগুলিই পরে স্টেশনে পরিণত হয়।



সুড়ঙ্গগুলির মধ্যে সব থেকে লম্বা ৩৩ নম্বর ব্যারগ সুড়ঙ্গ। ১১৪৩.৬১ মিটার লম্বা। ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার বেগে দৌড়লে ব্যারগ সুড়ঙ্গ পেরোতে টয় ট্রেনের সময় লাগে ২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। শিবালিকেরও প্রায় তাই লাগল। ব্যারগ সুড়ঙ্গ পার হলেই ব্যারগ স্টেশন। আমরা ব্যারগে পৌছলাম সকাল ৭টা ৩৪-এ। ট্রেন থামতেই যাত্রীরা সবাই যে যার মতো নেমে গেলেন। ঘুরে দেখতে লাগলেন চারপাশ। রেলের কর্মীরা তুললেন খাবারদাবার, জল। প্রায় আধ ঘণ্টা ব্যারগ স্টেশনে দাঁড়াল শিবালিক। তারপর আবার যাত্রা শুরু।

এতক্ষণ কিছু মনে হয়নি, ট্রেনে খাবার তোলা হতেই খিদেটা যেন চাগাড় দিয়ে উঠল। রাতের রেল ক্যান্টিনের ডাল-ভাতে আর কতক্ষণ চলে! কিছুক্ষণ পরই অ্যাটেন্ডেন্ট এসে সবার সামনে ছোট ছোট ফোল্ডিং টেবিল পেতে দিয়ে গেলেন। তারপর ছোট ছোট ট্রে-তে করে এল ২ পিস ব্রাউন ব্রেড, ওমলেট, মটর-গাজর সেদ্ধর সঙ্গে আলু ভাজা, ছোট প্যাকেটে বাটার, টম্যাটো সস। খাওয়ার পর বড়দের জন্য চা। ছোটদের পাশাপাশি, চা না নিলে বড়দের জন্যও ফ্রুট জুস।

জানালা দিয়ে ভালই রোদ এসে পড়েছে কামরায়। ছুটছে শিবালিক। খেতে খেতে পাহাড়ে উঠছি আমরা। প্রথম দিকে দু’ধারে কিছু ছোট ছোট পাহাড়ি বাড়ি ঘর চোখে পড়ছিল। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর সেগুলো উধাও হয়ে গেল। কখনও একপাশে উঁচু পাহাড় আর অন্যপাশে গভীর খাদ। আবার কখনও ছোট ছোট ঝরনা। হিমালয়ের প্যানোরামিক ভিউ।



রেলপথ তৈরির সময় সিমলা পৌঁছতে পাহাড় কেটে তৈরি করতে হয়েছিল ১০৭টি সুড়ঙ্গ ও ৮৬৪টি সেতু। এখন আছে ১০৩টি সুড়ঙ্গ, অসংখ্য সেতু। যার মধ্যে একটি ১৮.২৯ মিটার লম্বা স্টিলের সেতু। অন্যান্যগুলি অনেকটা গ্যালারির মতো দেখতে। প্রাচীন রোমান স্থাপত্যের আদলে তৈরি। কান্দাঘাট ও কানোহ স্টেশনের মাঝের ৪৯৩ নম্বর সেতুটি ‘আর্চ গ্যালারি’ নামে পরিচিত। এটি তিন স্তর গ্যালারির মতো পাথরের তৈরি। সোনওয়ারা ও ধরমপুরের মাঝে অবস্থিত ২২৬ নম্বর সেতুটি পাঁচ স্তর বিশিষ্ট গ্যালারির মতো।

বাইরে ঝলমলে রোদ। পরিস্কার আকাশ। জানালায় সরে সরে যাচ্ছে রোদে ভেজা পাহাড়, খাদ, জঙ্গল, ঝরনা, ঘরবাড়ি। একের পর এক স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে শিবালিক। দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে সময়। ট্রেনের থেকেও যেন জোরে ছুটছে সে।

সকাল ১০টা ৪৩। ধীর হয়ে এল ট্রেনের গতি। বাইরে তাকিয়ে দেখি, ‘সিমলা’ লেখা একটা বোর্ড জানালার পাশ দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে। আমাদের যাত্রা শেষ! অদ্ভূত এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হওয়ার আনন্দ সবার চোখে মুখে। সঙ্গে মন খারাপও, এবার নামতে হবে তো!

কীভাবে যাবেন - সিমলা যাওয়ার অনেক রাস্তা। কলকাতা থেকে ট্রেনে কালকা হয়ে। কলকাতা থেকে দিল্লি বা চণ্ডীগড় হয়েও যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন - সিমলায় অসংখ্য হোটেল। নিজের মতো বেছে নিলেই হল। অনলাইনে সার্চ করতে পারেন।

কখন যাবেন -

মার্চ থেকে জুন -এই সময় আবহাওয়া সুন্দর থাকে। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য আদর্শ। তবে বরফ পাবেন না।

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর - বর্ষাকাল। সবুজ সিমলা উপভোগ করতে চাইলে আদর্শ সময়। কিন্তু ধসের ভয় থাকে।

অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি - বরফ পড়া দেখতে চাইলে উপযুক্ত সময়। কিন্তু হাড় কাঁপানো ঠান্ডা!