কলকাতা: সাল ২০০৪। কেন্দ্রে তখন ইউপিএ এক সরকার। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল কংগ্রেস আর তার সবথেকে বড় শরিক সিপিআই(এম)। লোকসভায় তখন তারা ৪৩, যার মধ্যে বাংলা থেকেই ছিল ২৬। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব আচারিয়া, তড়িৎ তোপদার, মহম্মদ সেলিম, শমীক লাহিড়ীর মতো বাঘা বাঘা বামপন্থী সেবার বাংলা থেকে জিতে দিল্লি গিয়েছেন। সেই তুলনায় সংসদীয় অভিজ্ঞতায় ‘নবীন’ ছিলেন কলকাতা উত্তর পশ্চিম কেন্দ্র থেকে জয়ী সুধাংশু শীল। পরপর পুরসভার ভোট, বিধানসভা নির্বাচন জিতে লোকসভায় হেভিওয়েট সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়ে সাংসদ হয়েছিলেন তিনি। আর এই বিরল নজিরই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নজরে এনে দিয়েছিল সুধাংশু শীলকে।


 

(প্রাক্তন সাংসদ সুধাংশু শীল)

তদানীন্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং সিপিআই(এম) সাংসদ সুধাংশু শীলের প্রথম আলাপ লোকসভায়। সেটাও তৎকালীন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে। প্রথম সাক্ষাতেই ‘নবীন’ সাংসদকে দেখে দক্ষ পার্লামেন্টেরিয়ান বলেছিলেন, ‘তোমার কথা তো অনেক দিন ধরেই জানি। ইফ আই এম নট রঙ, একই টার্মে কাউন্সিলর, এমএলএ, এমপি আজ পর্যন্ত কেউ হয়নি। দেখ, তোমার নাম গিনেস বুক-এ না উঠে যায়।’ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় হেসে বলেছিলেন, ‘ইউ আর রাইট, আজ পর্যন্ত এমন নজির আর কারও নেই।’ এটাই ছিল সূত্রপাত। এরপর ৫ বছর সময়ে একাধিকবার প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মন্ত্রক বদলেছে, বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসেরও পাকাপাকি ভাবে বিচ্ছেদ হয়েছে, কিন্তু অটুট থেকেছে প্রণব-সুধাংশু সম্পর্ক।


কাশীপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে কর্মী নিয়োগ, বাঙালির রসনাতৃপ্তির সম্ভার পোস্ত থেকে ৮০ শতাংশ ‘এক্সচেঞ্জ ডিউটি’ কমিয়ে ১০ শতাংশ করে দেওয়া – সুধাংশু শীলের এক কথায় করে দিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। উত্তর কলকাতার সাংসদের কথায় বিশেষ নজর দিয়েছিলেন কুমোরটুলির উন্নয়নের জন্যও।


এমনকি দেবেশ দাসের ভিসা সমস্যা মিটিয়ে দিয়েছিলেন একদিনে। পরবর্তীতে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সুশান্ত ঘোষেরও, সৌজন্যে সেই সুধাংশু শীল। পরবর্তীতে প্রণবের কাছে বামেদের ‘বার্তাবাহক’-ও হয়ে ওঠেন এই সুধাংশুবাবু। অনিল বিশ্বাস পর্যন্ত স্বর্ণকারদের সমস্যা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য সুধাংশু শীল মারফত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন।


স্মৃতিচারণায় সুধাংশু শীলের মনে পড়ছে ঐতিহাসিক ওয়ান টু থ্রি চুক্তির ওপর ভোটাভুটির কথাও। তখন পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউপিএ এক সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করবে। হুইপ জারি হয়েছে, সংসদে ভারত-মার্কিন নিউক্লিয়ার চুক্তির বিরুদ্ধে ভোট দিতে হবে প্রত্যেক সিপিএম সাংসদকে। সেই সময় সুধাংশু শীলকে প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “তোমরা কী ভাবছ, ভোটাভুটি করে সরকার ফেলে দেব? যদি এটা ভেবে থাকো, তাহলে মুর্খের স্বর্গে বাস করছ।” সংসদে দাঁড়িয়ে সেদিন সাফারিতে হাত ঢুকিয়ে কংগ্রেসি রাজনীতির ‘চাণক্য’ বলেছিলেন, “ম্যাজিক ফিগার ইজ ইন মাই পকেট।” হলও তাই। বামেদের ভরাডুবির পর প্রণবের মুচকি হাসিতে ভাবটা ছিল ‘কেমন দিলাম’ গোছের।  আর সেটাই ছিল ওস্তাদের শেষ মার।



(ইউপিএ চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধী ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহর সঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়)

অল্প কয়েক বছরে রাজনৈতিক পরিসরের বাইরে প্রণব-সুধাংশু তৈরি হয়েছিল পারিবারিক সখ্যও। প্রণব-পত্নী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় দেশের ফার্স্ট লেডি হলেও সুধাংশ শীলের কাছে ছিলেন ‘শুভ্রা বৌদি’। ২০১৭ সালে ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, তবে প্রোটোকলের কারণে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আসতে পারেননি। বৌভাতে নবদম্পতির জন্য রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে এসেছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সই করা শুভেচ্ছাবার্তা ও ফুল।



(প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পাঠানো শুভেচ্ছা বার্তা)

শেষবার প্রণব-সুধাংশু সাক্ষাৎ হয়েছিল রাইসিনা হিলসে। তারপর টেলিফোনে টুকটাক কথা। গত ৩১ অগস্ট প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে একেবারে জন্য নিভে গেল সেই যোগাযোগ। ছেদ পড়ল দেড় দশকের সম্পর্কে।