পথ দেখাচ্ছে সল্টলেক। চাপও বাড়াচ্ছে।
২৫ এপ্রিল, পঞ্চম দফার ভোটের দিন উত্তর ২৪ পরগনা জুড়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাশাপাশি রাজ্য পুলিশের দাপট দেখে আপ্লুত আম-ভোটার ও বিরোধীরা। তবে সে দিন সমস্ত আলো যেন কেড়ে নিয়েছিল সল্টলেক। তাই ভোট মিটতেই নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিম-সহ জেলার অন্য পুলিশ কর্তারা ভাল কাজের শংসাপত্র আদায় করে নিয়েছেন।
তবে এখানেই থেমে থাকতে চায় না কমিশন। ৩০ এপ্রিল, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি ও দক্ষিণ কলকাতায় ষষ্ঠ দফার ভোটের জন্য পুলিশ-প্রশাসনের কাছে তাদের বার্তা— ওরা পেরেছে। আপনাদেরও পারতে হবে। মডেল হোক সল্টলেক।
অথচ সাত মাস আগে এই পুলিশেরই অন্য রকম আচরণ দেখেছিলেন সল্টলেকবাসী। চোখের সামনে ভোট লুঠ হচ্ছে দেখেও জাভেদ শামিমের বাহিনী দিনভর ঠুঁটো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। গত বছর ৩ অক্টোবর পুরভোটের দিন উর্দিধারীদের এমন কদর্য চেহারা দেখে চার দিকে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। বাহিনীর প্রধান হিসাবে ঘরে-বাইরে ধিক্কৃত হন শামিমও। তার পর থেকেই ভিতরে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। গত সোমবার প্রথম সুযোগেই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ছাপিয়ে গিয়ে দাপট দেখালেন দুষ্কৃতী দমনে। কলঙ্কের দাগ মুছতে পেরে খুশি শামিম নিজেও।
রাজ্যের পুলিশ কর্তাদের মতে, উত্তর ও মধ্য কলকাতায় ভোটের দিন নতুন পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্রকে ভয়ডরহীন ভাবে নেতৃত্ব দিতে দেখা গিয়েছিল। সল্টলেকের ভোট-পরিচালনায় জাভেদ শামিমরা সেটাই এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন।
কী ভাবে সফল হল উত্তরের পুলিশ? পুলিশের মতে, সল্টলেক-রাজারহাটে বরাবর শাসক দলের ‘ভোট মেশিনারি’ সামলায় মূলত বহিরাগতরা। তাদের সঙ্গে সঙ্গত করে সিন্ডিকেট। এ বার ভোটের তিন দিন আগে থেকে ভাঙড়, হাড়োয়া এবং কলকাতার কিছু এলাকা থেকে আসা সেই ‘সাপ্লাই লাইন’কে সল্টলেকে ঢোকার মুখে আটকে দেয় পুলিশ। পাশাপাশি ভজাই, মাটি গফফর, মিনি গফফর, টুটুন গাজিদের মতো সিন্ডিকেট মাফিয়াদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। সিন্ডিকেটের অফিস ও বিভিন্ন ক্লাবে গিয়ে লোকজনকে হটিয়ে দেওয়া হয়। বাইক বাহিনীকে দেখামাত্রই খুলে দেওয়া হয় চাকার হাওয়া। আর অচেনা লোকদের দিয়ে সিন্ডিকেট-চাঁইদের ফোন করিয়ে গ্রেফতার করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এতেই কাজ হয়েছে।
এক পুলিশ-কর্তার ব্যাখ্যা, সল্টলেকের মতো গোটা জেলায় ভোটের দিন তেমন ভাবে বহিরাগতদের দাপট থাকে না। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, স্থানীয় দুষ্কৃতীরাই দাদাদের নেতৃত্বে নিজেদের এলাকার ‘ভোট মেশিনারি’ সামলায়। এ বার সেই দাদা ও দুষ্কৃতীদের বোতলবন্দি করার ছক কষেছিল জেলার পুলিশ। থানাগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কোনও ধরনের চাপের কাছে নতিস্বীকার নয়। জটলা দেখলেই লাঠি উঁচিয়ে ভিড় হাল্কা করে দিতে হবে। সেই কাজে তারা অনেকটাই সফল। প্রায় অক্ষরে অক্ষরে নির্দেশ মেনে ফল মেলায় জেলার পুলিশকর্মীরা কর্তাদের কাছ থেকে প্রশংসাসূচক এসএমএস-ও পেয়েছেন। রাজ্যের পুলিশ কর্তারা বলছেন, সে দিনের ভোটে নজরের কেন্দ্রে ছিল সল্টলেক। জাভেদের পুলিশ তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে।
শাসক দলের হৃদ্স্পন্দন বাড়িয়ে দেওয়া সেই সল্টলেক-দাওয়াই বাকি দু’দফা ভোটে পুরোমাত্রায় কাজে লাগাতে চায় কমিশন। সেই চাপ নিতে প্রস্তুত হচ্ছেন তিন জেলার পুলিশ কর্তারা। গা-ঘামানো শুরু হয়ে গিয়েছে বুধবার থেকেই। মনোভাব হল, ‘করব-লড়ব-জিতব রে’।
শনিবার কলকাতা পুলিশের এলাকায় ১০টি বিধানসভা কেন্দ্রের ভোট। রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্র ভবানীপুরও। লালবাজারের খবর, কলকাতায় প্রথম দফায় ভোটের আগে অভিযোগ উঠেছিল বেলেঘাটা-সহ বিভিন্ন এলাকায় আগের রাতে শাসক দলের দাদারা বিরোধী এজেন্ট ও ভোটারদের হুমকি দিচ্ছে। এ বার তা রুখতে নজরদারি থাকছে। দুষ্কৃতীদের ওপর নজরদারির জন্য গোয়েন্দা বিভাগ আটটি বিশেষ টিম গড়েছে।
কলকাতা পুলিশের গেমপ্ল্যান হল— বন্দর, তিলজলা-তপসিয়া, কসবা, যাদবপুর, টালিগঞ্জ এলাকার ক’জন দাদার উপরে নজরদারি বাড়ানো। কোনও বেচাল দেখলেই তাদের তুলে নেওয়া। আজ, শুক্রবার থেকে ৪৩টি কুইক রেসপন্স টিম থাকছে। অশান্তির খবর পেলেই ওই টিম দ্রুত পৌঁছে যাবে। সেই সঙ্গে এ বারই প্রথম কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ৩০টি ‘ফ্লাইং স্কোয়াড বাহিনী’। তারা তল্লাশির পাশাপাশি রুট মার্চ করবে। বুথের বাইরে গণ্ডগোল রুখতে থাকছে ৬৭টি ‘পুলিশ সেক্টর মোবাইল’। প্রতিটিতে থাকবেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর চার জওয়ান।
২১ এপ্রিলের ভোটে পুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের অভিযোগ উঠেছিল। এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রতিটি দলের সঙ্গে স্থানীয় থানার এক জন অফিসার থাকছেন। এর পাশাপাশি কলকাতা পুলিশের ডিসি পদমর্যাদার অফিসারদের নিয়ে পৃথক ১৫টি দল গড়া হয়েছে। প্রতিটি দলের নেতৃত্বে থাকবেন এক জন করে আইপিএস অফিসার। দুই থেকে তিনটি থানার দায়িত্বে থাকবেন ওই অফিসাররা। এ ছাড়াও বিশেষ কমিশনার থেকে শুরু করে যুগ্ম কমিশনারদের বিশেষ বাহিনী থাকছে। যারা বিভিন্ন এলাকায় টহল দেবে। পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘আমরা অল-আউট খেলব।’’
উর্দির মর্যাদা রাখতে মরিয়া দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশও। গত পুরভোট অবাধ করতে চেষ্টা করেছিল জেলা পুলিশ। তবু ছাপ্পা ভোট ও গা-জোয়ারি পুরোটা আটকানো যায়নি। কিন্তু ‘টিম জাভেদ’-এর জোশ দেখে এ বার বাড়তি সক্রিয় থাকবে জেলা পুলিশ। নিচুতলার পুলিশকর্মীদের কথায়, ‘‘বড়কর্তারা হাতে লাঠি তুলে নিয়েছেন। আমাদের আর চাপ নেই। বাড়াবাড়ি দেখলেই লাঠিপেটা করব।’’ এক এসডিপিও-র কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে পুলিশের কনভয় টহল দেবে। ভোটার ছাড়া ময়দান ফাঁকা রাখতে বদ্ধপরিকর আমরা। ওই দিন আমরা দবঙ্গ-ওয়ান-টু-থ্রি, আরও অনেক কিছু।’’ জেলার ৩১টি কেন্দ্রে থাকছে ৩৩৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী, ১০ হাজার রাজ্য পুলিশ।
জেলার পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরীর কথায়, ‘‘সদিচ্ছা থাকলেও পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এ বার উপর থেকে নিচুতলা পর্যন্ত সব স্তরে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করতে আমরা বদ্ধপরিকর। এটা বুঝবেন, আমাদেরও পরিবার রয়েছে। সেখানেও জবাব দিতে হয়।’’
হুগলির ২৪টি থানা এলাকায় এ দিনই রাত-পাহারা শুরু করে দিয়েছে পুলিশ। শুরু হয়েছে নাকাবন্দি। হুগলি পুলিশ লাইনে কেন্দ্রীয় বাহিনী আলাদা কন্ট্রোল রুম খুলেছে। উত্তরপাড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া পর্যন্ত নদীপথে চলছে পাহারা। এক পুলিশকর্তা জানান, হাওড়া, কলকাতা, বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগনার মতো যে সব জেলায় ভোট হয়ে গিয়েছে, সেখান থেকে নদীপথে লোক হুগলিতে ঢুকে পড়তে পারে। তাই আশপাশের জেলাগুলির সঙ্গে সমন্বয় করার দায়িত্ব নিয়েছেন খোদ এসপি। আর এসপি প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, ‘‘অতীতে যাই হোক, এ বার স্থলে-জলে ফোর্স থাকছে। আমরা তৈরি। কেউ পার পাবে না।’’