কালকা মেলের দৌলতে একটা দিন আমাদের রাস্তাতেই নষ্ট হয়েছে।
সিমলার জন্য হাতে ছিল মাত্র ৩ রাত ৪ দিন। ফলে বেড়ানোর পরিকল্পনাটা নতুন করে সাজাতে হল। ইচ্ছে ছিল, হোটেলে ওঠার পর ফ্রেশ হয়ে, খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নেব প্রথম দিন। বিকেলে এদিক-ওদিক ঘুরে পরের দিন থেকে শুরু হবে সিমলা সফর। কিন্তু সব ওলটপালট করে দিয়েছে কালকা মেল।

শিবালিক এক্সপ্রেস থেকে নামার পর সিমলা স্টেশনের বাইরে বেরোতেই ছেঁকে ধরল গাড়িওয়ালারা। হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি। আমাদের হোটেল আগে থেকেই বুক করা ছিল। উইংগেট ইন। মল রোডের শেষে থ্রি স্টার হোটেল। হোটেলে ফোন করে আগেই জেনে রেখেছিলাম, স্টেশন থেকে হোটেলে যেতে গাড়ি ভাড়া লাগবে বড়জোর ১৫০টাকা। ফলে বেশি দর কষাকষি করতে হল না। ১৫০ টাকাতেই গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিল হোটেলে।


হোটেলটা বাইরে থেকে দেখতে অদ্ভূত! ঘরগুলো কী রকম তা বাইরে থেকে বোঝাই যায় না। আসলে, ইংরেজ আমলে ব্রিটিশ অফিসারদের থাকার জন্য তৈরি হয়েছিল বাড়িটি। পরে কিছুটা সংস্কার করে গড়ে উঠেছে হোটেল। ঘরগুলো বড়, সুন্দর করে গোছানো। দেওয়ালে বাঁধানো ছবি। বড় বড় দু’টো খাট। খাটে নরম গদি। কেবল টিভি, ইন্টারকম। বড় কাচের জানালা দিয়ে বাইরে সুদৃশ্য পাহাড়!

ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে স্নান, খাওয়া সেরে তৈরি। আজকে আমরা কোনও গাড়ি নেব না। পায়ে হেঁটে ঘুরে নেব কাছাকাছির দেখার জায়গাগুলো। মল রোড, সিমলা রিজ, চার্চ, লোয়ার বাজার, হিমাচল স্টেট মিউজিয়াম...।

মল রোড দিয়ে শুরু হল আমাদের সিমলা দেখা। সিমলা রেল ষ্টেশন থেকে মল রোড মাত্র এক কিলোমিটার। তবে যেতে সময় লাগবে অনেকটা। পাহাড়ি রাস্তায় দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করবেন না। হাঁফ ধরে যাবে। তখন বেড়ানোর আনন্দটাই মাটি! আমাদের হোটেলের কাছেই সিমলা আকাশবাণী ভবন। ১৯৫৫ সালে ১৬ জুন সম্প্রচার শুরু করেছিল আকাশবাণী, হিমাচল প্রদেশ। প্রথমে ঢুঁ মারলাম সেখানে। মেন গেট পেরিয়ে বেশ কিছুটা ভেতরে যেতেই আটকালেন নিরাপত্তারক্ষী। নিরাপত্তার কারণে পর্যটকদের একেবারে ভেতরে যাওয়া নিষেধ।

পাহাড়ি পথ বেয়ে কিছুটা যেতেই বাঁদিকে পড়ল সিমলার প্রধান ডাকঘর। গাঢ় সবুজ রঙের বাড়িটা পুরো কাঠের তৈরি। সেখান থেকে বাঁদিকে ইউটার্ন নিলে খাড়াই রাস্তা। সেই রাস্তায় কিছুটা এগোলে ডানদিকে, সিমলা দূরদর্শন কেন্দ্র। আরও ১০০ মিটারের মতো সোজা ওপরের দিকে উঠলে একটা বড় গেট। গেট পেরোলে পাহাড়ের মাথায় বিশাল সমতল। এখানেই হিমাচল স্টেট মিউজিয়াম। ১৯৭৪ সালের ২৬ জানুয়ারি সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় এই সংগ্রহশালা। বিশাল এলাকাজুড়ে সাজানো হিমাচল প্রদেশের শিল্প-কলা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নমুনা। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা মিউজিয়াম। টিকিট মাথা পিছু ২০টাকা। বিদেশিদের জন্য ১০০ টাকা। ভেতরে স্টিল ছবি তুলতে চাইলে ৫০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। ভিডিও তুলতে গেলে নিতে হয়ে বিশেষ অনুমতি, টিকিট ১৫০০ টাকা। প্রতি সোমবার ও ছুটির দিন বন্ধ সংগ্রহশালা। আমাদের হাতে সময় কম ছিল। তাই ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বেরিয়ে আসতে হল।আপনারা গেলে সময় নিয়ে যাবেন। অসাধারণ সংগ্রহশালা!


হোটেলে ঢুকে দেওয়ালে বাঁধানো একটা ছবি চোখে পড়েছিল। ছবির নীচে লেখা, গর্টন ক্যাসেল। হিমাচল স্টেট মিউজিয়াম দেখে নীচে নেমে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাত্‍ একটা বাড়ির সঙ্গে মিলে গেল ছবিটা। ভাল করে দেখি, সেই ক্যাসেল। ইংরেজ আমলে তৈরি একটা ক্যাসেল। অসাধারণ স্থাপত্য। এখন এলাকার নামী হোটেল। হায়দরাবাদেও এরকম একটা হোটেলে আমরা ছিলাম, অম্রুথা ক্যাসেল। সেই হোটেলের কথা পরে কখনও লিখব।

মল রোডের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশে পড়ল হিমাচল প্রদেশ বিধানসভা ভবন, আর্মি ব্যারাক, রেলওয়ে বোর্ডের অফিস। কিন্তু পা যেন আর চলতে চাইছে না। সবাই একটা জায়গায় বসলাম। দেখলাম, খাদের ধারে এক ব্যক্তি সেদ্ধ ডিম নিয়ে বসেছেন। ১০ টাকা পিস! দেখেই জিভে জল! খোসা ছাড়িয়ে মাঝখানটা ছুরি দিয়ে অল্প কেটে নুন, কুচনো ধনেপাতা আর পেঁয়াজ ভরে দিলেন। খেতে বেশ ভাল লাগল। চেনা ডিমের অচেনা স্বাদ। রসনা তৃপ্তির পর ফের শুরু হল চলা।

মল রোডের কাছাকাছি এসে চড়াই রাস্তাটা যেন আরও খাড়া হয়ে উঠেছে। পাশ দিয়ে মাথায়, পিঠে জঙ্গলের কাঠ, গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে হন হন করে চলে যাচ্ছেন স্থানীয়রা। আমরা যেন আর এগোতেই পারছি না! ধীরে ধীরে একটু এগোতে ডানদিকে চোখে পড়ল পুলিশ সুপারের অফিস। বিদেশি পর্যটকদের রেজিস্ট্রেশনও এখানে হয়। এসপি অফিস পেরোতেই সামনে মল রোড। সিমলার বাণিজ্যিক কেন্দ্র। বিশাল চওড়া রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য দোকান, মল, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্রাভেল এজেন্টের অফিস। কেনাকাটা আর পেট পুজোর স্বর্গোদ্যান। চাইলে চেখে দেখতে পারেন হরেক রকম স্ট্রিট ফুড, শপিং করতে পারেন মন খুলে। জায়গাটা ঘুরে বুঝতে পারলাম, কেন এত জনপ্রিয় মল রোড।



মল রোড় থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গিয়েছে নীচের দিকে। পাহাড়ের গা বেয়ে খাড়াই সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলে লোয়ার বাজার। স্বার্থক নাম! লোয়ার বাজার অনেকটা কলকাতার গড়িয়াহাটের ফুটপাথের মতো। রাস্তার দু’পাশে ঘিঞ্জি দোকান। চলতে গেলেই লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেতে হয়। লোয়ার বাজারে মিলবে সব, অচল পয়সা থেকে জামাকাপড়, শীতের পোশাক, খাবার-দাবার, মশলা, শো পিস। টুকটাক কেনাকাটা করতে করতে ব্যাগ ভারী হয়ে উঠল। সময়ও কেটে গেল অনেকটা। ফের সিঁড়ি বেয়ে ওপরের মল রোডে।

মল রোড শেষ হলেই শুরু দ্য রিজ। বিশাল খোলা জায়গা, সিমলার ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক। চারপাশে পাইন, ওক, রডডেনড্রনের জঙ্গল। রিজ-এ বিখ্যাত তিন ব্যক্তিত্বের মূর্তি - মহাত্মা গাঁধী, ইন্দিরা গাঁধী ও হিমাচল প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই এস পারমার-এর। শৈলশহরের জনজীবনের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই রিজ। এর নীচের জলাশয় থেকেই শহরের বিস্তীর্ণ অংশে জল সরবরাহ করা হয়।

১৮৪৪ সালে তৈরি গীর্জাটিও সিমলার একটি দর্শনীয় জায়গা। উত্তর ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম গীর্জা। অসাধারণ এলিজাবেথীয় স্থাপত্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। গীর্জার মধ্যে রয়েছে দেশের অন্যতম বড় পাইপ অর্গান।

হাতে আর সময় নেই। পা-ও আর চলতে চাইছে না। এবার ফেরার পালা। রিজ থেকে সূর্যাস্ত দেখে নামতে শুরু করলাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। ফেরার রাস্তা সব সময় ছোট বলে মনে হয়। আমাদেরও তাই হল। যে রাস্তা যেতে ঘণ্টাখানেক লেগেছিল, সেই রাস্তা পেরোতে লাগল মাত্র ১৫ মিনিট। ফেরার সময় দেখলাম, আর্মি ব্যারাকে বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা নামানো হচ্ছে। সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম। নতুন একটা অভিজ্ঞতা।

হোটেলের ঘরে ফিরে এবার বিশ্রাম।

গাড়ি বুক করা আছে। কাল সকালে লং জার্নি......।।

কীভাবে যাবেন -
কীভাবে কখন যাবেন, এই সাইটে আগের লেখা (‘শিবালিক’-এ সূর্যোদয়: হিমালয়ের কোল বেয়ে খেলনা ট্রেনে কালকা থেকে সিমলা)-তেই বলেছি।

‘শিবালিক’-এ সূর্যোদয়: হিমালয়ের কোল বেয়ে খেলনা ট্রেনে কালকা থেকে সিমলা
কোথায় থাকবেন -
সিমলায় সব থেকে ভাল থাকার জায়গা হল মল রোড। কারণ, এখান থেকে যে কোনও জায়গায় যাওয়া সুবিধাজনক। তাই, মল রোডে গিয়ে নিজের পছন্দ মতো একটা হোটেল খুঁজে নিয়ে উঠে পড়ুন। ৭৫০ টাকা থেকে হোটেলের ভাড়া শুরু। পিক সিজন হলে ভাড়া একটু বেশি হতে পারে। মোটামুটি ১০০০ টাকা বাজেট হলে ভাল হোটেলই মিলবে। যাওয়ার আগে একটু ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে নিলে সুবিধা হবে। চাইলে অনলাইন বুকিংও করে নিতে পারেন।