কলকাতা: নতুন বছরে নতুন অভিভাবক পেল বাবু।


হইহট্টগোল তার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু করোনা অতিমারির জেরে দীর্ঘ সময় প্রায় নিঃসঙ্গ কাটাতে হয়েছে। বাবু নাকি মুষড়ে পড়েছিল, কমিয়ে দিয়েছিল খাওয়াদাওয়া। তার দেখাশোনা করেন যাঁরা, তাঁদের সেরকমই উপলব্ধি। তবে নিউ নর্ম্যালে ভিড় ফিরেছে বাবুর চারপাশে। করোনা ভ্যাকসিন আশার আলো জোগাচ্ছে। বাবুর জীবনে সেই খুশিই কার্যত দ্বিগুণ হয়ে গেল। কারণ, নতুন বছরে বাবু পেয়ে গেল একজোড়া অভিভাবক। সোহিনী সেনগুপ্ত ও সপ্তর্ষি মৌলিক!

বাবুকে চিনতে পেরেছেন? না পেরে থাকলে, আসুন আলাপ করিয়ে দেওয়া যাক। বাবু আলিপুর চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জি। চিড়িয়াখানার বাসিন্দাদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয়। কচিকাঁচাদের চোখে ‘হিরো’। তার এনক্লোজারের বাইরে থিকথিকে ভিড় দেখলেই শুরু হয়ে যায় বাবুর হরেক কারনামা। কখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে ডিগবাজি খায়। কখনও আবার মুখের নানা ভঙ্গিমা। মাঝে মধ্যে মজা করার জন্যই হয়তো স্থির হয়ে মাথায় হাত দিয়ে আকাশ-কুসুম কল্পনা করে নিতেও দেখা যায় তাকে।

বাবুর আমুদে এই মেজাজ জনতার দরবারে ভীষণ প্রিয়। এহেন বাবুকে এবার দত্তক নিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব সপ্তর্ষি ও সোহিনী। হঠাৎ কেন এই অভিনব উদ্যোগ? উত্তরে সোহিনী বললেন, 'এটা আমার কাছে নতুন কিছু নয়। ছোট থেকেই আমি পশু পাখি ভালোবাসি। আমার মা-বাবা এভাবেই আমায় বড় করে তুলেছেন। রাস্তার কোনও কুকুরের যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তাকে তুলে এনে শুশ্রূষা করাটা আমার অভ্যাস। ছোটবেলা থেকেই আমার অনেক পোষ্যও ছিল।'

পশুপ্রেম থাকলেও বাবুকে দত্তক নেওয়ার ধারণাটা কিন্তু সপ্তর্ষির। এবিপি আনন্দকে বললেন, 'আমার কোনওদিন চিড়িয়াখানায় যেতে ভালো লাগত না। পশুপাখিদের খাঁচায় বন্দি করে রেখেছে দেখলে আমার খারাপ লাগত। সম্প্রতি একটা ছুটিতে আমি আর সোহিনী চিড়িয়াখানা ঘুরতে গিয়েছিলাম। ওখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, অনেক পশু চিড়িয়াখানাতেই জন্মেছে। অনেককে আবার উদ্ধার করা হয়েছে চোরাশিকারিদের হাত থেকে। সব শুনে আমার ধারণা বদলায়, মনে হয় সত্যি হয়তো পশুরা এখানেই ভালো আছে।' একই সুর সোহিনীর গলায়, বললেন, 'এখন জঙ্গল কতটা নিরাপদ তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। চোরাশিকারিদের উৎপাত তো রয়েছেই, সঙ্গে আগুন লেগে যাওয়ার বিপদ। এখন চিড়িয়াখানার অনেক উন্নতি হয়েছে। ছোটবেলায় দেখতাম দর্শকরা পশুদের দিকে পয়সা, খাবার ছুড়ে মারছেন। আমার খুব কষ্ট হত। এখন সেই প্রবণতা কমেছে। তার জন্য অবশ্য যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।'

বাবুই কেন? মানবশিশু নয়, দত্তক নেওয়ার জন্য কেন পছন্দ হল একটা পশুকে? এই প্রশ্ন একাধিকবার এসেছে দম্পতির কাছে। 'আমার ইচ্ছা', স্পষ্ট উত্তর সোহিনীর। বললেন, 'পশুরাও আমার পরিবারের একটা অংশ। বাবুকে দত্তক নিয়ে যেদিন ফিরলাম, সেদিন রাতেই পাড়ার একটা কুকুরের দুর্ঘটনা হল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে ছুটলাম ক্লিনিকে। আমার কাছে এটা অভিনব কোনও বিষয়ই নয়।' অন্যদিকে সপ্তর্ষি বলছেন, 'করোনা পরিস্থিতি আমাদের বুঝিয়েছে, প্রকৃতি আমাদের কাছে কতটা প্রয়োজনীয়। আমরা যেভাবে প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণ নষ্ট করেছি তারই ফল বোধহয় ভুগতে হচ্ছে।  খুব মনে হয়েছে পশু সংরক্ষণ খুব প্রয়োজন। এখন মনে হয় মানুষের থেকে হয়ত আমাদের পশুদের ওপর দায়বদ্ধতা একটু বেশি। আর্থিক সামর্থ্য থাকলে সব পশুকেই দত্তক নিতাম। আর বাবু এত মানুষ ভালোবাসে, ও বোধহয়। বাবু কিন্তু আমার চেয়ে ৩ বছরের বড়।' হাসতে হাসতে যোগ করলেন সপ্তর্ষি।

চিড়িয়াখানায় পশুদের দত্তক নেওয়ার প্রচলন রয়েছে ২০১৫ সাল থেকেই। যদিও করোনা পরিস্থিতির পর থেকে সোহিনী-সপ্তর্ষি চান, তাঁদের কাজের নয়, প্রচার হোক পশুপ্রেমের প্রবণতার। সোহিনী যোগ করলেন, একটা শিশুকে আমরা যেমন পাঠ্য বই, ল্যাপপট দিই, তেমনই তাকে সেখানো উচিত পশু সংরক্ষণের বিষয়টিও। প্রকৃতিকে না বাঁচালে, ৫০ বছর পর যে শিশু জন্মাবে সে তো জলও পাবে না!'