সিমলা থেকে মানালি যেতে একটা দিন রাস্তাতেই কেটে গিয়েছে। তবে অসাধারণ ছিল জার্নিটা। ২৬৫ কিলোমিটার লম্বা পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছে সৌন্দর্যের ঝাঁপি উপুড় করা প্রকৃতি। আসতে আসতে দেখা হয়েছে ৭টি স্পট। হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধে প্রায় ৭টা। সন্ধ্যার আলোয় বাইরে থেকেই অসাধারণ দেখতে লাগছে পাইন কাঠের কারুকাজ করা হোটেলটাকে। মানালির সেরা হোটেলগুলির মধ্যে অন্যতম। হোটেল বাইকে নীলকণ্ঠ।
তিন তারা হোটেল। দামি আসবাবে সাজানো বিশাল ঘর। ঘরজুড়েও উজ্জ্বল পাইন কাঠের কাজ। বিশাল ওয়ার্ড্রোব, ড্রেসিং টেবল, টি কাউন্টার, মিনি ফ্রিজ, শরীর ডুবে যাওয়া গদিতে মোড়া সোফা, কিং সাইজের খাট।কাচের জানালার ওপাশে বারান্দা। জানালার পর্দা সরাতেই চোখে পড়ল অন্ধকার পাহাড়ের ধাপে ধাপে অসংখ্য জোনাকির আলো। আসলে জোনাকি নয়, হোটেল বা স্থানীয়দের ঘরবাড়ির আলো।

ঘুম ভাঙল সকাল ৮টায়। বিছানার ডান দিকের জানালার পর্দা সরাতেই সামনে বিশাল পাহাড়। রাতের জোনাকিরা মুখ লুকিয়েছে দিনের আলোর গভীরে। পাহাড়ের সেই সব ধাপে তখন আপেলের বাগান। সব পাতা ঝরিয়ে বরফের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আপেল গাছের সারি।



নগ্গার রোডে আমাদের হোটেল। হোটেল থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে বিয়াস। গাড়ি ছুটছে সোজা ঢালু রাস্তায়। গন্তব্য সোলাং ভ্যালি। মানালি শহর থেকে লেহ-মানালি হাইওয়ে ধরে রোটাং পাস যাওয়ার পথে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সোলাং ভ্যালি। হিমাচল প্রদেশের আকর্ষণীয় জায়গাগুলির মধ্যে অন্যতম। সমুদ্র তল থেকে ৮ হাজার ৪০০ ফুট উঁচু। মানালি মল রোড থেকে গাড়িতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৩২ মিনিট। রোটাং পাস খোলা থাক বা না থাক, ফেরাবে না সোলাং ভ্যালি। তাই সব সময় জমজমাট থাকে এই উপত্যকা। কুলু জেলার সোলাং ভ্যালি অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে ঘন জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে ডানা মেলে পাখির মতো ওড়ার মজাই আলাদা! সোলাং ভ্যালির পাশাপাশি, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য বিখ্যাত নারকাণ্ডা এবং কুফরিও।

গাড়ি থেকে নামতেই ছেঁকে ধরলেন ঘোড়ার সহিসরা। রেট কুফরির মতোই। একটি ঘোড়ায় একজন, ৫০০ টাকা। যে সহিস আমাদের ছেঁকে ধরলেন, তাঁর বয়সটা একটু কম। বয়সের সুযোগ নিয়ে আমরাও তাঁকে পাল্টা ছেঁকে ধরলাম। শেষমেশ রফা হল আমাদের দাবি মতো। ৩টি ঘোড়ায় ৪ জন, ১২০০ টাকা।



কুফরির মতো এখানেও সব ঘোড়ার লাগাম বাঁধা হল একসঙ্গে। সামনের ঘোড়ায় ছেলে-মেয়ে। মাঝের ঘোড়ায় স্ত্রী, পিছনে আমি। সবার আগে লাগাম হাতে সহিস। পাথুরে পথে খটাখট খটাখট শব্দ করতে করতে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল তিন ঘোড়া। সামনে পিছনে পাশে আরও আনেকগুলি। কেউ চড়ছে, কেউ বা নামছে। সোলাং এবং কুফরিতে এখনও বেশ জাঁকিয়ে আছে পরিবহণের পুরনো এই মাধ্যম। চড়াই পাথুরে রাস্তায় ঘোড়ার পিঠে বেশ লাগছে!

সোলাং ভ্যালির পরিচিতি ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার ভ্যালি’ নামে। পাথুরে জলাধারের কিনারায় পাথুরে ঘরবাড়ি। পাইন বনের আড়ালে পাহাড়ের উপত্যকায় কী অসাধারণ সব গ্রাম। মাথার ওপর চক্কর কাটছে গ্লাইডার.... একটা দু’টো প্যারাশ্যুটও চোখে পড়ছে। পাশ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে স্নো স্কুটার। ঘোড়ার চালে চলেছি আমরা। যত ওপরে উঠছি, ততই কাছে আসছে বরফের সাদা মুকুট পরা পাহাড়ের সারি। পাশ দিয়ে কলকল করে বয়ে যাচ্ছে সুন্দরী ঝরনা। সহিস বললেন, আর একটু পরেই পৌঁছে যাব সোলাং উপত্যকায়।।
(পরের পর্বে উপত্যকা, রাইড আর বরফের শিবলিঙ্গের কথা)

সোলাং সফরের সেরা সময় -
ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি

কীভাবে যাবেন -
কলকাতা থেকে বিমানে দিল্লি বা চণ্ডীগড়। সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে মানালি। কলকাতা থেকে ট্রেনে কালকা হয়েও যেতে পারেন। কালকা থেকে মানালি সরাসরি গাড়ি পাবেন। সিমলা দেখা না হয়ে থাকলে কালকা থেকে টয় ট্রেনে সিমলা। সিমলা থেকে গাড়িতে মানালি। চাইলে সিমলা থেকে বাসেও মানালি যেতে পারেন। কিন্তু বাসে গেলে একটা সমস্যা। মানালি যাওয়ার পথে কুলু, মাণ্ডি, রাফটিং পয়েন্ট, প্যাণ্ডো ড্যাম, সুন্দরনগর লেক, গুরুদ্বারের মতো জায়গায় বাস থামবে না। গাড়িতে গেলে এইসব জায়গাগুলো দেখা যাবে।

কোথায় থাকবেন -
সোলাং-এ হোটেল হাতে গোণা। তাই সবাই মানালিতে থেকে সোলাং ভ্যালি বা রোটাং পাস ঘুরে আসেন। তবে থাকতে চাইলে পাবেন হোটেল বা রিসর্ট।
আগে যা লিখেছি -
মানালির পথে-৩: বিপজ্জনক সুড়ঙ্গের অন্ধকারে ভয়ঙ্কর সুন্দর ৪ মিনিট!!
মানালির পথে-২: তারপর যে-তে যে-তে যে-তে, এক নদীর সঙ্গে দেখা...
সিমলা থেকে ভারতের সুইজারল্যান্ড-এর পথে
সিমলার ডায়েরি (তৃতীয় দিন): ভাইসরিগ্যাল লজ... মাশোবরার আপেল বাগান... পাহাড়ের মাথায় গল্ফগ্রিন...!
সিমলার ডায়েরি (দ্বিতীয় দিন): অভয়ারণ্যে কৃষ্ণসার... কুফরির ঘোড়া.... বিশ্বের দীর্ঘতম হনুমান মূর্তি!
সিমলার ডায়েরি (প্রথম দিন): মল রোড, দ্য রিজ, লোয়ার বাজার, গর্টন ক্যাসেল, স্টেট মিউজিয়াম
‘শিবালিক’-এ সূর্যোদয়: হিমালয়ের কোল বেয়ে খেলনা ট্রেনে কালকা থেকে সিমলা