কলকাতা: স্বাস্থ্যে হাল ফেরাতে কড়া বিধি নিয়ে বিধানসভায় পাশ হল বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রক সংক্রান্ত 'দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট (রেজিস্ট্রেশন, রেগুলেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি) বিল, ২০১৭'। বিলকে ‘ঐতিহাসিক’ উল্লেখ করে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘এই বিল আগামী দিনে দেশের মডেল হবে।’ রাজ্যপাল সই করলেই বিজ্ঞপ্তি। সময় নষ্ট করব না, জানালেন মুখ্যমন্ত্রী। বিল নিয়ে মমতা বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে গাফিলতিতে শাস্তি হয়।’ তাঁর দাবি, ‘রাজ্যের মত কোথাও এমন চিকিৎসা পাওয়া যায় না।’ তিনি যোগ করেন, ‘বিহার, উত্তর-পূর্ব, ওড়িশা থেকে মানুষ আসে চিকিৎসা করাতে।’ মুখ্যমন্ত্রী জানান, ফ্রি চিকিৎসা দিতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। বিনা পয়সায় ব্লাড টেস্ট, এমআরআই হচ্ছে। এদিন বামেদের সমালোচনা করে মমতা বলেন, ‘৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন কী করেছেন ?’ তাঁর কটাক্ষ ‘বিরোধিতা করতে হবে বলেই সমালোচনা করা হচ্ছে।’ মমতা বলেন, ‘শিশুদের টিকাকরণ ৮০ থেকে ৯১ শতাংশ করেছি। পোলিও টিকাকরণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য।’ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, মালদা, মুর্শিদাবাদ, সাগর দত্ত, হলদিয়া, দুর্গাপুর মেডিকেল কলেজ এবং পুরুলিয়া, রায়গঞ্জ, কার্শিয়ং মেডিকেল কলেজে মধুর স্নেহ তৈরি করা হচ্ছে। গর্ভবতী মায়েরা মারা গেলে বাচ্চারা যাতে দুধ পায় সেই ব্যবস্থা তৈরি রাখা হবে। তিনি জানান, চিকিৎসকদের বয়ঃসীমা বাড়ানো হয়েছে। মমতা বলেন, সরকারি হাসপাতালে কখনও কোনও ঘটনা ঘটলে আমরা হইচই করি। কিন্তু কোটি কোটি মানুষের চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালেই হয়। মমতা বলেন, ভালো বিল আনার জন্যে আমি ৬ ঘণ্টা ধরে বসে বিলের তথ্য খুঁটিয়ে দেখেছি। তাঁর দাবি, ৪০০০০ কোটি টাকা ঋণ শোধ করছি। ঋণ শোধ করেও সরকারি তহবিলের পয়সা কাজে লাগানো হচ্ছে। তিনি যোগ করেন, ৩০ জনের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোম নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রোগী মারা গেলে তার অপারেশন করা হচ্ছে, অমানবিক ঘটনা। লোভ বাড়তে বাড়তে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গি হয়নি, তবু ডেঙ্গির জন্য রক্ত পরীক্ষা, শুধুমাত্র টাকার জন্য। বিধানসভায় সঞ্জয় রায়ের মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুললেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ফিক্সড ডিপোজিটের কাগজ রেখে দেওয়া হয়েছিল। রোগীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্যান কার্ড, সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মমতা বলেন, রোগী গেলেই বিভিন্ন রকমের চিকিৎসা। কোথায় পরীক্ষা করতে হবে তার জন্য প্রেসক্রিপশন, সেখানে পরীক্ষা করলেই মিলবে কমিশন। তিনি যোগ করেন, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা-খরচ। এনাফ ইজ এনাফ। মমতা দাবি করেন, একটা ওষুধের দাম বাইরে ১০ হাজার টাকা, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল থেকে কিনতে হচ্ছে ২৪ হাজার টাকায়। আমরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল-নার্সিংহোম, সব জায়গায় একই অবস্থা। মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন, সম্পত্তি নষ্ট হোক চাই না, কিন্তু যখন সব বাঁধ ভেঙে যায়। তখন বাধ্য হয়ে, অভিযোগ যাতে না হয়, সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হয়। তিনি বলেন, কখনও বিল না দিলে দেহ আটকে রাখা, বিল বাড়িয়ে দেখানো হয়। কখনও এমারজেন্সি পেশেন্টকে টাকা না দিলে চিকিৎসা করা হয় না। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, সরকারি জমি নিয়ে ফ্রি-তে চিকিৎসা করছে না।
মমতা বলেন, বিল আনার উদ্দেশ্য হল--
- স্বচ্ছতা নিয়ে আসা।
- অকারণে হয়রানি বন্ধ করা।
- গাফিলতি হলে তদন্ত করা।
- অভিযোগ প্রমাণে সংস্থার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, নতুন বিল বলা হয়েছে --
- লাইসেন্স পেতে ন্যূনতম পরিকাঠামো রাখতে হবে
- ইচ্ছামত টাকা নেওয়া যাবে না
- দুর্যোগের ফলে অসুস্থ ব্যক্তিকে জরুরি পরিষেবা
- দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্যক্তিকে ফেলে রাখা যাবে না
- বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিতেই হবে
- পাবলিক গ্রিভান্স সেল চালু করতে হবে
- যেখানে রোগীর পরিবার অভিযোগ জানাতে পারবে
- ই-প্রেসক্রিপশন চালু করতে হবে
- রোগীকে ডিসচার্জের সময় সব তথ্য দিতে হবে
- রোগীর পরিবার যদি মনে করে অন্যত্র ট্রান্সফার
- সেটা করতে দিতে হবে
- পরিষেবার জন্য নির্দিষ্ট টাকাই নিতে হবে
- প্যাকেজের বেশি টাকা নেওয়া যাবে না
- বাড়তি খরচ করা যাবে না
- বাড়তি খরচ চিকিৎসার আগে রোগীর পরিবারকে জানাতে হবে
- ১০০-র বেশি বেড বিশিষ্ট বেসরকারি হাসপাতাল
- ফেয়ার প্রাইস মেডিসিন শপ করলে অনেক ছাড় পেতে পারে
- সরকারের থেকে জমি বা অন্যান্য সুবিধা পেয়েছেন
- গরীবদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিতে বাধ্য থাকবেন
- বাধ্য থাকবে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম
- প্যান কার্ড, জমির দলিল, ফিক্সড ডিপোজিট নেওয়া যাবে না
- লাইসেন্স না থাকলে জরিমান ২৫০০০ টাকা
- রেকর্ড নষ্ট করলে জরিমানা
- শর্ত না মানলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের জেল
- স্বাস্থ্য পরিষেবাদানকারী সংস্থার জন্য গাফিলতিতে
- রোগীর ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ
- ৬ মাসের মধ্যে দিতে হবে ক্ষতিপূরণ
- ১৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিশন গঠন করা হবে
- কম ক্ষতি হলে ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা
- গাফিলতিতে মৃত্যুর জরিমান ১০ লক্ষ টাকা
- ৫০ লক্ষ টাকা জরিমানা ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে কমিশনের
- জেলার নার্সিংহোমে নজরদারি বাড়িয়েছি
- চিকিৎসা কিন্তু সেবা, ব্যবসা নয়
মমতা বলেন, বিল রাজ্যপাল সই করার পর নোটিফিকেশন জারি করব। সময় নষ্ট করব না। তিনি যোগ করেন, বিলে গাফিলতি থাকলে ঠিক করা হবে। চিকিৎসকদের কাছে তাঁর আবেদন, ভালো কাজ করুন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন। সেরকম হলে বেসরকারি হাসপাতাল ছেড়ে আপনারা সরকারি হাসপাতালে চলে আসুন। মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, সরকারি-বেসরকারি একসঙ্গে কাজ করুক। যাঁরা অমানবিক ছিলেন, তাঁরা মানবিক হোন।
চিকিৎসা ছাড়াও, শহরের রাস্তায় গাড়ি ও বাইক দুর্ঘটনা নিয়েও এদিন উদ্বেগ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন--
- দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছে, এটা উদ্বেগের।
- শহরে বাইক রেস বন্ধ করতে কড়া আইন।
- প্রয়োজনে বাইক বাজেয়াপ্ত করুন।
আবার বেসরকারি স্কুলে ডোনেশন নিয়েও সুর চড়ান মুখ্যমন্ত্রী। বলেন--
- বেসরকারি স্কুলে চড়া ডোনেশন নিয়েও ভাবনাচিন্তা করতে হবে।
- বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউ এত বেশি চার্জ নেয়।
- পরীক্ষা শেষ হলে আমি একদিন বসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে বসব।
- মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলেই সিদ্ধান্ত।