ফিসফাস শুরু হয়েছিল নারদ-কাণ্ড সামনে আসার পরেই। লোকজন বলাবলি করছিল, শেষ পর্যন্ত কলকাতার মেয়র কি না পাঁচ লাখ টাকার ‘শিকার’ হলেন! তা-ও ভিডিও ফুটেজে পুরোটা তাঁকে নিতে দেখা যায়নি। লাখ খানেক টাকা বাকি ছিল।
যে মেয়র জীবনযাপনে কার্পণ্যের ধার ধারেন না, পোশাক-আশাকে, হাতের রোলেক্স ঘড়ি বা গলার বারবেরি মাফলারে নিজের সচ্ছলতার প্রমাণ দেন, নারদের স্টিং ভিডিওয় সেই তিনি-ই মাত্র ২/৪ লাখ টাকা তোয়ালে মুড়ে নিচ্ছেন— এটা ছড়িয়ে পড়ার পরে স্বাভাবিক ভাবে নানা মহল কিছুটা বিস্মিতই হয়। মেয়র অবশ্য বিষয়টি নস্যাৎ করতে গিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এক পরিচিত (পরে জানা গিয়েছে সেই ব্যক্তি তৃণমূলেরই বিধায়ক ও বর্তমানে ডেপুটি মেয়র ইকবাল আহমেদ) নিয়ে এসেছিলেন বলেই অপরিচিত লোকের সঙ্গে তিনি নিজের খাস কামরায় দেখা করেন। ঘনিষ্ঠ মহলে শোভন এ-ও দাবি করেন, ভিডিওয় যে টাকা তাঁকে তোয়ালে মুড়ে নিতে দেখা গিয়েছে, সেটাও নাকি তিনি নিজের জন্য ‘হস্তগত’ করেননি। বরং তোয়ালে খুলে বান্ডিল তৎক্ষণাৎ ‘হস্তান্তর’ করে দেন।
এর সবটাই নারদের ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ার পরের সাফাই। তাতে নিজের বা দলের গায়ের কালি যে মোছা যায় না, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর রবিবারের বক্তৃতাই তার প্রমাণ। যেখানে মমতা বলেছেন, ‘‘আগে জানলে নিশ্চয়ই ভাবতাম। কিন্তু প্রার্থী ঘোষণার পরে তো আর বদলাতে পারি না।’’ এর পরেই ফিসফাসটা গুঞ্জনের আকার নিয়েছে। এবং ছড়িয়ে গিয়েছে দাবানলের মতো।
মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে অন্যতম নির্ভরযোগ্য তাঁর সাধের ‘কানন’ (শোভন)। অন্য নানা দায়দায়িত্ব তিনি ‘অতি বিশ্বস্ততা’র সঙ্গে সম্পাদন করতে পটু। বিধানসভা ভোটে এ বারও দাঁড়িয়েছেন বেহালা পূর্ব কেন্দ্রে। কিন্তু লড়াইটা যেখানে ভাবমূর্তি বাঁচানোর, সেখানে স্টিং ভিডিওয় তাঁকে তোয়ালে মুড়ে টাকা নিতে দেখা যাওয়ার পরে দলের ‘স্বচ্ছতা’ বজায় রাখার স্বার্থে ভোটের পরে শোভনকে মেয়র পদে রাখার ঝুঁকি মমতা নেবেন কি?
দলেরই একাংশ বলছেন, নারদ-কাণ্ড মেয়র, ডেপুটি মেয়র, মন্ত্রী সাংসদদের জড়িয়ে পড়া দলনেত্রীকে যে বিড়ম্বনায় ফেলেছে, তাতে বিধানসভা ভোটে জিতলেও তাঁদের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে রেখে দেওয়ার ঝুঁকি নেওয়াটা মমতার পক্ষে কঠিন। ফলে দলের স্বচ্ছতা ও ভাবমূর্তি বজায় রাখার স্বার্থে নেত্রী তাঁদের সরিয়ে দিতে পারেন বলেই অনেকের মত। তাই ‘স্নেহের কানন’-এর ক্ষেত্রেও মমতা ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ হলে অবাক হবেন না বলেই মনে করছেন তাঁরা। এখনই বড় খাঁড়া ঝুলছে ডেপুটি মেয়র ইকবাল আহমেদের ঘাড়ে। কারণ, ভিডিও প্রকাশের পরে জানা গিয়েছে, ইকবালই ঘুষ-কাণ্ডের হোতাকে নিয়ে গিয়েছেন অনেকের কাছে। তাতে দলনেত্রী আরও ক্ষুব্ধ বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
আর এক অংশ আবার মনে করেন, জিতে বিধায়ক হয়ে এলে ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে— জনগণের রায়েই এসেছেন শোভন। সহজেই কলঙ্কও সাফ করে দেওয়া যাবে। তা হলে মমতা হয়তো ‘সাধের কানন’কে পদ থেকে সরাবেন না। আর সরাতে চাইলেও শোভনের মতো নির্ভরযোগ্য বিকল্প এই মুহূর্তে মমতার কাছে আছে কি? মজা করেই কেউ কেউ বলছেন ‘মেয়র গেলে মেয়র আসবে, কিন্তু ‘দিদি’র ‘কানন’ গেলে আর এক জন কানন আসবে কি?’
সে কথা হয়তো কানন নিজেও জানেন। জল্পনা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে সে জন্যই বোধহয় মেয়র সোজাসাপ্টা বলছেন, ‘‘কাকে কান নিয়ে গেছে বলে আপনারা কাকের পিছনে দৌড়তে ভালবাসেন। আমি নিজের কানে হাত দিয়ে দেখে নিতেই অভ্যস্ত।’’
তবু যদি শোভনকে সরতেই হয়, তাঁর জায়গায় আসবেন কে? কিছু নাম ঘোরাফেরা করছে পুর-মহলে। তাঁদের প্রত্যেকেরই যেমন কিছু ভাল দিক আছে, তেমনই আছে দুর্বলতার দিকও। আবার কারও কারও প্রশ্ন, নাকি বাইরে থেকে একেবারে অন্য কাউকে নিয়ে আসবেন নেত্রী? সে ক্ষেত্রে তো তাঁকে কলকাতার কোনও ওয়ার্ড থেকে জিতিয়ে আনতে হবে।
কোন পথে হাঁটবেন মমতা?
নেত্রীর মনের খবর সঠিক জানেন এক জনই।
তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।