জতিঙ্গা(অসম) : একযোগে 'আত্মহত্যা' করছে পাখিরা !
অবাক হচ্ছেন ? হওয়ারই কথা। কারণ, পাখিদের আত্মহত্যার প্রবণতা নেই। তা সত্ত্বেও বছরের পর বছর এই ঘটনার সাক্ষী থাকছে অসমের ডিমা হাসাও জেলার জতিঙ্গা গ্রামের বাসিন্দারা।
জতিঙ্গা। অসমের একমাত্র হিল স্টেশন। পাহাড়ের খাড়াইয়ে অবস্থিত আদিবাসী অধ্যুষিত ছোট্ট গ্রাম। 'পাখিদের মৃত্যু উপত্যকা' বলে পরিচিত। পাহাড় ঘেরা এই গ্রামটি অপূর্ব সুন্দর। ফি বছর বর্ষার শেষ দিকে ; সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে এই জতিঙ্গাতেই ভিড় জমায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। পরিষায়ীর পাশাপাশি থাকে স্থানীয় পাখিরাও। এখানে একযোগে আত্মহত্যা করে তারা। প্রকৃতির এই অদ্ভুত ঘটনা সত্যিই অবাক করার মতো।
প্রচলিত ধারণা, পাখিদের আত্মহত্যার প্রবণতা নেই। তা সত্ত্বেও প্রত্যেক বছর এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। 'আত্মহত্যা' করার জন্য নির্দিষ্ট ধরনের পরিবেশও বেছে নেয় পাখিরা। কুয়াশাচ্ছন্ন বা মেঘলা হতে হবে আবহাওয়া। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ১০টার মধ্যে মূলত আত্মহত্যা করতে দেখা যায় পাখিদের।
স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, আকাশে উড়তে থাকা 'দুষ্ট আত্মারা' এই পাখিদের নামিয়ে আনে। শুধুমাত্র কয়েকটি প্রজাতির পাখি যারা 'দুষ্ট আত্মা'-কে অপমান করে, তাদেরই নিচে নামিয়ে আনা হয়।
কেন এই অদ্ভুত আচরণ পাখিদের ?
দীর্ঘদিন চলতে থাকা এই ঘটনার রহস্য উদঘাটনে নেমে পড়েন পক্ষী-বিশেষজ্ঞরা। গবেষণায় তাঁরা দেখেছেন, এখানে স্থানীয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আছে। যেমন- মাছরাঙা, বক, ব্লাক বিটার্ন, টাইগার বিটার্ন। আত্মহত্যা করে এইসব প্রজাতির পাখিরাই। তবে বছরের এই নির্দিষ্ট সময়টাকেই কেন আত্মহত্যার জন্য বেছে নেওয়া হয় ? গবেষণায় দেখা গেছে, বর্ষার শেষ দিকে অসমের অধিকাংশ জলাশয়ই পূর্ণ থাকে। যেদিকেই চোখ যায় শুধু জল আর জল। বন্যার চেহারা নেয় চারপাশ। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের সম্বলের বাসস্থানটুকুও হারিয়ে ফেলে পাখিরা। স্বাভাবিকভাবেই মাথা গোঁজার জন্য তাদের অন্যত্র যেতে হয়। এই যাত্রাপথেই পড়ে জতিঙ্গা। ১৯৮৮ সালে ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছিল অসমে। সেবার বিশাল সংখ্যক পাখিকে আত্মহত্যা করতে দেখা গিয়েছিল। তবে, বহু দূর থেকে আসা পরিষায়ী পাখিদের মধ্যে এই অদ্ভুত আচরণ দেখা যায় না।
একটা বড় অংশের পাখি এই বন্যা পরিস্থিতিতে উড়ে আসার পর জতিঙ্গায় আলো দেখে অবতরণ করে। এখান থেকে আর উড়ে যাওয়ার চেষ্টাও করে না। গবেষণা অনুযায়ী, এই পরিস্থিতিতে পাখিরা বিহ্বল হয়ে পড়ে। সম্ভবত ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কারণে। এই ধরনের পাখিগুলি সহজেই গ্রামবাসীর শিকার হয়। অনেকে কুয়াশা এবং বাতাসে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা উড়ে গিয়ে বড় বড় গাছ বা অন্য কিছুতে আঘাত করে নিজেদের জখম করে ফেলে। সেইসময় গ্রামবাসী বাঁশ বা অন্য কিছু দিয়ে পাখিদের আঘাত করে নামিয়ে আনে।
তথ্য অনুযায়ী, এখানে পাখির ৪৪ রকমের প্রজাতি অদ্ভুত এই আচরণ করে। এই পাখিগুলি মূলত উত্তর দিকে থেকে আসে। তবে, বহু দূর থেকে আসা কোনও পরিযায়ী পাখি এই আলোর ফাঁদে আকর্ষিত হয় না। আশপাশের উপত্যকা বা পাহাড়ি এলাকা থেকে উড়ে আসে পাখিই শিকার হয়। গত বেশ কয়েক বছর ধরে স্থানীয়রা এই ঘটনা দেখে আসছে। সূর্যাস্তের সাথে সাথে শ'য়ে শ'য়ে পাখি গ্রামে নেমে আসে। তার পর দ্রুত গতিতে কোনও বাড়ি বা গাছের দিকে উড়ে গিয়ে নিজেদের আঘাত করে। সাথে সাথে ঘনিয়ে আসে মৃত্যু। গ্রামের বিশেষ দেড় কিলোমিটারের মধ্যে এই ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। স্থানীয়রা পাখির এই আগমনকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করে। স্থানীয় পরিযায়ী পাখিদের যাতায়াতের পথে পড়ে এই রাস্তাটি। এই সুযোগেই গ্রামবাসীও তাদের ফাঁদে ফেলে। তবুও, প্রতি বছর এই সময়ে পাখিরা এখানে আসে এবং ফাঁদে পড়ে। পাখিদের এভাবে আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে, গবেষকরা অবশ্য এর পিছনে বিভিন্ন কারণের কথা জানিয়েছেন। জতিঙ্গাতেই শুধু পাখিদের এই অদ্ভুত আচরণ দেখা যায় এমনটা নয়, এই ঘটনা দেখা যায় ফিলিপ্পিন্স ও মালয়েশিয়ার মতো দেশেও।
কীভাবে জতিঙ্গা যাবেন ?
হাফলং শহর থেকে নয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গুয়াহাটির দক্ষিণে ৩৩০ কিলোমিটার দূরে। জতিঙ্গা পাখি প্রদর্শন কেন্দ্রও রয়েছে। যেখানে থাকার জায়গাও আছে।