কলকাতা: প্রতি বছরই দুর্গাপুজোর জন্য আকুল হয়ে থাকে বাঙালি। বাংলায় যখন বারোয়ারিগুলো খুঁটিপুজো করে, সেদিন থেকেই যেন কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যায়। এই আমেজ কি বাংলার বাইরে গেলে সম্ভব? এই প্রশ্ন যদি মনে থেকে থাকে, তাহলে তার উত্তর মিলবে বার্লিন সর্বজনীনকে দেখলে। জার্মানির বার্লিনে খাঁটি বাঙালি পুজো। খুঁটিপুজো থেকে শুরু করে একেবারে দশমী, প্রতিটি ধাপে নিয়ম মেনে পালন করা হয় জার্মানির এই দুর্গাপুজো। হয় লক্ষ্মীপুজোও।
বার্লিনে Ignite-eV নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে, যা মূলত সেখানকার প্রবাসী বাঙালিদের হাতেই তৈরি। ওই সংস্থার উদ্যোগেই হচ্ছে এই বার্লিন সর্বজনীন (Berlin Sarbojonin) দুর্গোৎসব। পঞ্জিকা মেনে পুজো, ঢালাও ভোগের ব্যবস্থা থেকে নিঁখুত মুনশিয়ানায় তৈরি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। কী নেই সেখানে? একেবারে তিথি মেনে ১ অক্টোবর, ষষ্ঠী থেকে পুজো শুরু হচ্ছে এখানকার গণেশ হিন্দু মন্দিরে। গত বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালে প্রথম পুজো হয়। এবার, দ্বিতীয় বর্ষ। উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, অন্তত ১০০ সদস্য রয়েছেন এই গোটা সংগঠনে। সবাই কোনও না কোনওভাবে জুড়ে রয়েছেন এই পুজোর সঙ্গে। শুধু বাঙালিরাই নন, পাশে এসে দাঁড়ান অন্য প্রদেশের প্রবাসী ভারতীয়রাও।
ভাগে ভাগে দায়িত্ব:
এত বড় পুজো, কাজও অনেক। তাই আগেভাগেই শুরু হয়ে যায় যাবতীয় প্রস্তুতি। তৈরি হয় পুজো পরিচালনার কমিটি, কেউ কেউ থাকেন ভোগের বিভাগে, কারও দায়িত্ব থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য। নজর থাকে সাজসজ্জার উপরেও। তাই তৈরি হয় ডিজাইনিং টিম, যাঁরা পুজোর জন্য গোটা চত্বর সাজিয়ে তোলেন।
পুজোর আয়োজন:
আগের বছরেই প্রতিমা আনা হয়েছিল কুমোরটুলি থেকে। সেই প্রতিমাতেই এবারও পুজো হবে। দুর্গাপুজোয় নিয়ম থাকে, নানা উপাচার প্রয়োজন। সেগুলি কীভাবে জোগাড় হয়? উদ্যোক্তাদের একজন সুপর্ণ দত্ত জানাচ্ছেন, দীর্ঘদিনের প্রস্ততি নিয়ে ভারত থেকে আসে নানা সামগ্রী, কিছু ওই দেশেও পাওয়া যায়। অনেকসময়েই প্রবাসী বাঙালিদের কেউ এ দেশে এলে, তাঁরা ফেরার সময় ব্যবস্থা করে নিয়ে যান প্রয়োজনীয় কোনও জিনিস।
জিনিসপত্র তো তাও জোগাড় করা যায়, কিন্তু পুরোহিত? বিদেশ-বিভুঁইয়ে পুরোহিত নিয়ে চিন্তায় থাকেন অনেকেই। কিন্তু বার্লিন সর্বজনীনে সেই সমস্যা নেই। অন্যতম উদ্যোক্তা সুপর্ণ দত্ত জানাচ্ছেন, যিনি পুরোহিতের দায়িত্ব সামলান তাঁর নাম শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। পেশায় টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার শঙ্করবাবু জার্মানিতে রয়েছেন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। শুধু পৌরহিত্যই নয়, ঠিক উচ্চারণে অঞ্জলি দেওয়া, মন্ত্রোচ্চারণ করা এসবও তিনিই শিখিয়ে দেন। পুজোর উপাচারে যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে সেদিকেও কড়া দৃষ্টি থাকে তাঁর। শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থাকেন জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরে। পুজোর কদিন সেখান থেকে এসে বার্লিন শহরেই থাকেন তিনি। বার্লিন সর্বজনীনে হয় কুমারী পুজোও, জানাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
ভোগ এবং খাওয়াদাওয়া:
কোনও সর্বজনীন পুজো ভোগ ছাড়া ভাবাই যায় না। তাই যাতে সেদিকেও খামতি না থাকে তা দেখেন উদ্যোক্তারা। পুজোর সঙ্গে যুক্ত অরিজিৎ পাত্র জানাচ্ছেন, পুজোর সবদিন থাকে ভোগের আয়োজন। তাঁরা নিজেরাই বানান সেটা। তাছাড়া, পুজোকে কেন্দ্র করে থাকে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও। সেই দায়িত্ব কারা সামলায়? অরিজিৎ জানাচ্ছেন, ওই বিপুল দায়িত্ব সামলায় বার্লিনে প্রবাসী ভারতীয়দের তৈরি রেস্তরাঁ কর্তৃপক্ষ। তাঁরাই এই কাজের পুরো দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নেন।
প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান:
বাঙালি দুর্গাপুজো করবে অথচ গান-নাচ-নাটক থাকবে না, এমনটা সাধারণত হয় না। বার্লিন সর্বজনীনেও হবে না। ষষ্ঠী থেকে নবমী প্রতিদিন সন্ধেবেলা থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, এবার এত বেশি লোক যোগ দিতে চাইছেন যে সময় বের করতে প্রতিদিন অনুষ্ঠান করতেই হচ্ছে। শুধু তাই নয়, একদিন মঞ্চস্থ হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা। কলাকুশলী সবাই বার্লিনের প্রবাসী বাঙালি। তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও উইকএন্ডে সময় বের করে দীর্ঘদিন ধরে চলেছে অনুশীলন।
আয়োজন প্রায় সব তৈরি। শুধুমাত্র শেষ মুহূর্তের কিছু প্রস্তুতি চলছে। আর বাকি মাত্র কয়েকদিন। তারপর বাংলা থেকে বহুদূরে, বার্লিনের বুকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহজুড়ে ঝলমল করবে একটুকুরো বাংলা।
আরও পড়ুন: কানাডার ডারহামে একটুকরো বাঙালিয়ানা, কুমোরটুলির প্রতিমায় পুজো দেবী দুর্গার