মুম্বই: নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে, দু'পয়সা রোজগারের আশায় জুতো-সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবকিছুই করেছেন। টাকা রোজগার যেমন জরুরি, তেমনই নিজের আদর্শে অবিচল থাকাতেও বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তাই চরম সঙ্কটের সময়ও দল ছেড়ে এদিক ওদিক নড়েননি। তার ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। সাধারণ কর্মী থেকে এই মুহূর্তে শিবসেনার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হয়ে উঠেছেন একনাথ শিণ্ডে (Eknah Shinde)। একসময় অটো রিকশা চালিয়ে সংসার চালানো শিণ্ডে, ৫৮ বছর বয়সে মহারাষ্ট্রের (Maharashtra Politics) মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসলেন। কিন্তু এই দীর্ঘ যাত্রাপথে কম চড়াই উতরাই পেরোতে  হয়নি শিন্ডেকে। 


মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হলেন একনাথ শিণ্ডে


মহারাষ্ট্রের সাতারার মারাঠা সম্প্রদায়ের নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম শিণ্ডের। রোজগারের ভাল সুযোগের আশায় ৭০-এর দশকে তাঁর পরিবার মুম্বই সংলগ্ন ঠাণে-তে চলে আসে। ঠাণের মঙ্গলা হাইস্কুল অ্যান্ড জুনিয়র কলেজে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন শিণ্ডে। এর পর টাকা রোজগারে নেমে পড়েন। শুরুতে অটো রিকশা চালাতেন শিণ্ডে। সংসার চালানোর পক্ষে তা যথেষ্ট নয় বুঝে বিয়ার তৈরির কারখানাতেও কাজ করতেন পাশাপাশি। মাছের ভেড়িতে কাজ করেও বাড়তি রোজগার হতো। 


৮০-র দশকে শিবসেনার সংস্পর্শে আসা শিণ্ডের। দলের সাধারণ কর্মী হিসেবেই কাজ শুরু করেন। যোগ দিতে শুরু করেন মিটিং-মিছিলে। সেই সময় ঠাণের শিবসেনা জেলা সভাপতি আনন্দ দিঘের ছত্রছায়ায় এসে পড়েন। আনন্দের নেতৃত্বে সেই সময় ঠাণে এলাকায় শিবসেনার (Shiv Sena) দাপট তুঙ্গে।  আনন্দকে দেখে নিজের বেশভুষাতেও পিরবর্তন আনেন শিণ্ডে। অল্প দিনের মধ্যে ই আনন্দের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ ১৯৯৭ সালে ঠাণে পুরসভার আসনটি শিণ্ডেকে ছেড়ে দেন আনন্দ। তাতে জয়ী হয়ে গুরুদক্ষিণা দেন শিণ্ডে। 


২০০০ সালে শিণ্ডের সাংসারিক জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসে।  বোটিং করতে গিয়ে জলে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর দুই ছেলে, দীপেশ (১১) এবং সুভাদের (৭)। তার পর অবসাদে ডুবে যান শিণ্ডে। বেশ কয়েক মাস নিজেকে কার্যত ঘরবন্দি করে রেখেছিলেন। সেই সময় শিষ্যের পাশে ছিলেন আনন্দ। অবসাদের অন্ধকার থেকে বার করে আনতে শিণ্ডের কাঁধে আরও গুরুদায়িত্ব তুলে দেন তিনি। শিণ্ডেকে ঠাণে পুরসভার নেতা করে দেন আনন্দ। 


২০০১ সালে দিঘের মৃত্যুর পর ঠাণে এলাকায় শিণ্ডেই শিবসেনার সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। ২০০৪ সালে কোপরি-পাচপাখাড়ি আসন থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন তিনি। চার-চার বার ওই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত শিণ্ডে। গুরু দিঘের মতোই কম কথার মানুষ তিনি। কিন্তু যুদ্ধংদেহি মানসিকতার জন্য দলের কর্মীদের কাছে অসম্ভব  জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন শিণ্ডে। তার ফলে যত সময় এগোতে থাকে, শিবসেনার ততই উন্নতির সিঁড়ি চড়তে থাকেন তিনি। 


আরও পড়ুন: Maharashtra Crisis: কেন উদ্ধবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন একনাথ শিণ্ডে?


বালাসাহেব ঠাকরের মৃত্যুর পর উদ্ধব (Uddhav Thackeray) যখন শিবসেনার দায়িত্ব নেন, সেই সময় দলে আরও বেশি গুরুত্ব পান শিণ্ডে। গোড়াতেই বিজেপি-র (BJP) সঙ্গে ঝামেলা বেঁধেছিল উদ্ধবের। সেই সময় শিণ্ডেই দুই শিবিরের মাঝে সেতুবন্ধনের কাজ করেছিলেন। তার জেরে বিধানসভায় তাঁকে বিরোধী দলনেতা করে দেন উদ্ধব। পরবর্তী কালে জন কর্মসূচি দফতরের মন্ত্রীও নিয়ুক্ত হন। 


২০১৯ সালে বিজেপি-র সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে উদ্ধব নেতৃত্বাধীন শিবসেনা। ভিন্ন আদর্শে দীক্ষিত কংগ্রেস এবং এনসিপি-র সঙ্গে জোট গড়ে সরকার গঠন করে মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু উদ্ধবের এই সিদ্ধান্তে শুরু থেকেই অসন্তুষ্ট ছিলেন শিণ্ডে। উদ্ধবের সরকারে নগরোন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব পেলেও, এনসিপি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে বলে লাগাতার অভিযোগ পাচ্ছিলেন বিধায়কদের কাছ থেকে। তার পরও 'মাতোশ্রী'তর সঙ্গে শিবসেনা বিধায়কদের যোগায়োগের মাধ্যম হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেও পেরে উঠছিলেন না বলে জানা যায়। 


শিণ্ডের হাতে নগরোন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন উদ্ধব। সেখানে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও পুরনো সম্পর্কের খাতিরেই শিণ্ডেকে আক্রমণ করতে দেখা যায়নি বিজেপি-কে। বরং এনসিপি, কংগ্রেস এবং শিবসেনার অন্য নেতাদেরই লাগাতার নিশানা করে যাচ্ছিল তারা। সূত্রের খবর, উদ্ধবের উপর চটেছিলেন শিণ্ডে নিজেও। কারণ নিজে নির্বাচনী রাজনীতিতে না এসে চিরকাল দলের নেতা-কর্মীদেরই এগিয়ে দিতেন বালাসাহেব। অথচ উদ্ধব মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ছেলে আদিত্যকে যে ভাবে মন্ত্রিপদে বসান। তাই ঠাকরে পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেও, উদ্ধবে সরকারের মাথা হয়ে বসা এবং আদর্শের নিরিখে সম্পূর্ণ বিপরীত শিবিরের সঙ্গে জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি শিণ্ডে। 


তবে সম্প্রতি ঠাণে পুরসভা নির্বাচন ঘিরেই দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে বলে জানা যায়। ঠাণে-তে শিবসেনা একা লড়াইয়ে নামুক বলে মত ছিল শিণ্ডের। কিন্তু তাঁর প্রস্তাব খারিজ করে দেন উদ্ধব। জোটসঙ্গীদের সঙ্গে মিলে একজোট হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিশেষ করে দলের মুখপাত্র সঞ্জয় রাউতের অবস্থান নিয়ে চটে যান শিণ্ডে। কোথাও না কোথাও, এনসিপি এবং কংগ্রেসের কাছে শিবসেনার গুরুত্ব লঘু হয়ে পড়ছে বলে ধারণা জন্মায় তাঁর। তার জেরে উদ্ধব এবং তাঁর সম্পর্কেও চিড় ধরে বলে খবর। 


উদ্ধবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সটান মসনদে


সম্প্রতি গুরু দিঘেকে নিয়ে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করেন শিণ্ডে। তার প্রচারে শিণ্ডের উপস্থিতি ছিল নজর কাড়ার মতো। সংবাদপত্র থেকে টেলিভিশন চ্যানেল, সর্বত্র ছবির বিজ্ঞাপনে ছিলেন শিণ্ডে। তাতে তাঁর নির্ভীক, দৃঢ়চিত্ত ভাবমূর্তিকে তুলে ধরা হয়। এর পর থেকেই শিণ্ডে নেতা হিসেবে একক পরিচয় গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন বলে সূত্রের খবর। তারই ফলশ্রুতি স্বরূপ উদ্ধবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা।