নয়াদিল্লি: প্রতি ১০ বছর অন্তর জনগণনা হওয়াই দস্তুর ভারতে। বিগত ১৫০ বছর ধরে অন্তত তেমনই চলে আসছিল। নিয়মিত এ ভাবে জনগণনা চালানো হাতেগোনা কিছু দেশের মধ্যে তাই আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষ জায়গা ছিল। কিন্তু কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে এই রীতিতে পরিবর্তন চোখে পড়ছে (India Population Census)। কারণ ২০১১ সালের পর নিয়ম অনুযায়ী ২০২১ সালে জনগণনা  হওয়ার কথা থাকলেও, তা হয়ে ওঠেনি এখনও পর্যন্ত। বরং এখন শোনা যাচ্ছে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন মিটলে, তবেই জনগণনার কাজে হাত দিতে পারে কেন্দ্র (Lok Sabha Elections 2024)। 


২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন মিটলে জনগণনার কাজে হাত দিতে পারে কেন্দ্র


২০২১ সালে জনগণনা করাতে ২০১৯ থেকেই তৎপরতা শুরু হয়েছিল। তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ৮ হাজার ৭৫৪.২৩ কোটি টাকাও। কথা ছিল, ৩৩ লক্ষ জনগণনাকারীকে নামিয়ে আদমসুমারির কাজ সম্পন্ন হবে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এবং ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মোট দু’দফায় এই জনগণনার কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল, যাতে ২০২১-এর মাঝামাঝিই প্রাথমিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে দেওয়া যায়। কিন্তু অতিমারিকে কারণ হিসেবে তুলে ধরে জনগণনার কাজ স্থগিত করে দেওয়া হয়। ২০২২-এ ফের জনগণনার কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। প্রথম বারের জন্য ডিজিটাল মাধ্যমে জনগণনা হবে বলে ঢাকঢোলও বেজেছিল বিস্তর। কিন্তু তা-ও হয়ে ওঠেনি।


বার বার কাজ আটকে যাওয়ার পর, ২০২৩-এ জনগণনা শুরু হবে বলে শোনা যাচ্ছিল লুটিয়েন্স দিল্লিতে। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, এ বছর জনগণনার কোনও সম্ভাবনা নেই। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন মিটলে তবেই এই কাজে হাত দেবে কেন্দ্র। ফলে ১০ বছর অন্তর জনগণনার রীতিই শুধু ভঙ্গ হচ্ছে না, এতে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মাথাপিছু নাগরিকদের আয়, জনসংখ্যা এবং সম্পদের অনুপাত, জন্ম-মৃত্যুর হার, উদ্বাস্তু সমস্যা এবং সাক্ষরতার হিসেবেও বিরাট ব্যবধান তৈরি হচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।


১৮৭২ সালে ভারতে প্রথম বার জনগণনা হয়। তার পর থেকে বিগত ১৫২ বছর ধরে  প্রতি ১০ বছর অন্তর দেশের জনগণনার রীতি চলে আসছিল। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৬১ সালে ইন্দো-চিন যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কারণে তাতে সামান্য বিঘ্ন ঘটে। কিন্তু জনগণনার কাজ আটকে যায়নি। জনগণনার ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তথ্য় সংগ্রহ করা হয়। তাতে সাক্ষরতা, শিক্ষা, আবাস, পরিবার পিছু আয়, শরণার্থী সঙ্কট, নগরায়ন, জন্ম-মৃত্যুর হার, ভাষা, ধর্ম, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, সমাজ-সংস্কৃতি, জনসংখ্যা এবং সম্পদের সংক্রান্ত বিশদ তথ্য উঠে আসে শহর, গ্রাম, ওয়ার্ড এবং পঞ্চায়েত স্তর থেকে, যা অন্য কোনও পরিসংখ্যান চালিয়ে জোগাড় করা সম্ভব নয়।


আরও পড়ুন: Auto Expo 2023: আগামীকাল শুরু দেশের সবথেকে বড় গাড়ির মেলা, কত টাকা টিকিট,কোন কোন গাড়ি আসছে ?


জনগণনার আগে গণনাকারী নিয়োগ থেকে অন্য কাজে প্রস্তুতিতেই সময় লেগে যায় প্রায় এক বছর। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনস্থ রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং সেনসাস কনমিশনারের দফতরই গোটা বিষয়টি সম্পাদন করে। প্রথমে সব বাড়ির সংখ্যা নথিভুক্ত করা হয়। কোন বাড়ি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন,  কোন বাড়িটি ইজারায় নেওয়া, সেখানে শৌচালয়, জল, বিদ্যুৎ রয়েছে কিনা, সেই সংক্রান্ত তথ্যও নথিভুক্ত করা হয়। তার পর মাথা ধরে ধরে শুরু হয় মানুষ গণনা। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে জনগণনা আইনও আনা হয়। আলাদা করে গঠিত হয় রেজিস্ট্রার জেনারেল বিভাগ।


এর আগে, বিজেপি-র অটলবিহারি বাজপেয়ী সরকার জাত-ভিত্তিক জনগণনায় রাজি হয়নি। কিন্তু ২০১৮ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকার জানায়, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির নাগরিকদের জন্য পৃথক জনগণনা চালানো হবে। তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গড়ায় মামলা। তাতে কেন্দ্র জানায়, জাতভিত্তিক গণনা এখন সম্ভব নয়। আদালতে জানানো হয়, ১৯৫১ সাল থেকে জাত ভিত্তিক গণনা না হওয়ায়, তফসিলি জাতি, উপজাতি, অনগ্রসর শ্রেণির সঠিক সংখ্যা জানার উপায় নেই। কাজটি অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠেছে। যদিও বিহারের মতো বেশ কিছু রাজ্য জাত-ভিত্তিক গণনায় উদ্যোগী হয়েছে। জনগণনা বার বার পিছিয়ে যাওয়া নিয়ে কোভিডকে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা হলেও, অতিমারির সময়ই জনগণনা সম্পন্ন করেছে ব্রিটেন এবং চিন। তাতে প্রাপ্ত সব তথ্যই প্রকাশিত।


জনগণনা দেশের বৃহত্তম প্রশাসনিক কার্য। তার নিরিখেই দেশের সংসদ, বিধানসভা, পৌরসভা এমনকি পঞ্চায়েত স্তরে তফসিলি জাতি এবং উপজাতি আসন সংরক্ষণ করা হয়। জনগণনা না হলে, সেই আসন সংখ্যা অসম্ভব বাড়ানো হয়েছে, নাকি কমানো হয়েছে, তা-ও জানার উপায় থাকে না। একই ভাবে সংসদ এবং বিধানসভা কেন্দ্রগুলির পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রেও হিসেবে গরমিল থেকে যায়। গ্রাম এবং শহরের জনসংখ্যায় তারতম্য কত, সেই তথ্য়ও অধরা থাকে। জনগণনায় বার বার যোগ-বিয়োগ হয় না, একবারই তথ্য সংগ্রহ করা হয়, সেটিই একেবারে সঠিক বলে ধরা হয়। কিন্তু সেই জনগণনা বার বার পিছিয়ে যাওয়ায়, দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির আসল চিত্র অগোচরে থেকে যাচ্ছে।


দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির আসল চিত্র অগোচরে থেকে যাচ্ছে


এর আগে, জনগণনার সঙ্গে জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জিকে (NPR) জুড়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল কেন্দ্রের তরফে। সেই নিয়ে বিতর্কের জেরে জনগণনা প্রক্রিয়ার উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জিকে জনগণনার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের যুক্তি ছিল, দেশের ‘স্বাভাবিক নাগরিক’দের তালিকা তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য। যদিও বিরোধী শিবিরের দাবি ছিল, জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জির মাধ্যমে আসলে বিশেষ জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে চায় কেন্দ্র। তাই জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি নিয়ে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, তার সঙ্গে জনগণনাকে জুড়ে দিলে আরও বিরোধিতার মুখে পড়তে হতে পারে কেন্দ্রকে। তার জন্যই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের সুফল না মেলা পর্যন্ত কেন্দ্র জনগণনা আটকে রাখতে চাইছে বলে দাবি বিরোধীদের।