মুম্বই: ট্যুইটারে তর্জন-গর্জন স্ত্রীর। দিল্লি-গুজরাত ছুটোছুটি নিজের। প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নাটকীয় পরিবর্তন। দেবেন্দ্র ফড়ণবীস (Devendra Fadnavis) নন, মহারাষ্ট্রের (Maharashtra Political Tussel) মুখ্যমন্ত্রী হলেন একনাথ শিণ্ডে (Eknath Shinde), তা-ও আবার বিজেপি-রই সমর্থনে। সংখ্যায় বেশি হয়েও ফড়ণবীস মুখ্যমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী পদের লোভ করেননি বলে মন্তব্য করেন শিণ্ডে। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই জানা যায়, ফড়ণবীস মুখ্যমন্ত্রীই হতে চেয়েছিলেন। রাজি হননি বিজেপি নেতৃত্ব। তাই শিণ্ডে সরকারে শামিলও হতে চাননি তিনি। শেষে অমিত শাহের হস্তক্ষেপে বরফ গলে। উপ মুখ্যমন্ত্রী হতে নিমরাজি হন ফড়ণবীস। কিন্তু দু'সপ্তাহ ব্যাপী নাটকের নেপথ্য নায়ক ফড়ণবীসকে কেন মুখ্যমন্ত্রী করা হল না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিস্তর। যদিও এই সিদ্ধান্তের মধ্যে জোড় কৌশল দেখছে রাজনৈতিক মহল। 


কোন সমীকরণে উপ মুখ্যমন্ত্রী ফড়ণবীস


সুপ্রিম কোর্টে আস্থাভোট স্থগিতের আর্জি খারিজ হয়ে যাওয়ার পর  নিজে থেকেই মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন উদ্ধব ঠাকরে (Uddhav Thackeray)। তার পর এ দিন শিণ্ডে এবং ফড়ণবীস, দু'জনে সরকার গড়ার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন রাজভবনে। তখনও পর্যন্ত ফড়ণবীসই মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন বলে মুখে মুখে ফিরছে সর্বত্র। কিন্তু সকলকে চমকে দিয়ে ফড়ণবীস নিজেই ঘোষণা করে দেন, মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন শিণ্ডেই। তিনি সরকারে কোনও পদে থাকছেন না। তাতে শোরগোল পড়ে যায় বিজেপি-র অন্দরেও। দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে যিনি মহা আঘাড়ি জোটের প্রত্যেকটি পদক্ষেপের উপর নজর রাখছিলেন, তাঁর প্রস্থান মনে ধরছিল না কারোরই। জানা যায়, মুখ্যমন্ত্রী না করাতেই গোঁসা হয়েছে ফড়ণবীসের। 


এর পর বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা মঞ্চে অবতীর্ণ হন। ফড়ণবীসকে উপ মুখ্যমন্ত্রী হতে অনুরোধ জানান তিনি। কিন্তু তাতেও রাজি হননি ফড়ণবীস। শেষ মেশ এগিয়ে আসতে হয় অমিত শাহকে (Amit Shah)। শিণ্ডে একা দায়িত্ব সামলাতে পারবেন না, বিজেপি-কে রাজ্যে ধরে রাখতে গেলে ফড়ণবীসের সরকারে থাকাটা জরুরি বলে বোঝান তিনি। তাতেই শপথ গ্রহণের আগের মুহূর্তে ফড়ণবীসের মন পাল্টায় বলে সূত্রের খবর। ফড়ণবীস উপ মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন বলে প্রথমে ট্যুইট করেন শাহ। সেই ট্যুইটই রিট্যুইট করে ফড়ণবীস জানান, একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে দলের নির্দেশ শিরোধার্য। তার পর রাজভবনে শিণ্ডে শপথ নেওয়ার পর শপথবাক্য পাঠ করেন তিনিও। 


তবে শিণ্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী এবং ফড়ণবীসকে উপ মুখ্যমন্ত্রী করার সিদ্ধান্তের পিছনে বিজেপি-র রাজনৈতিক কৌশলই দেখছেন পর্যবেক্ষকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, মহারাষ্ট্রের দু'বারের মুখ্যমন্ত্রী ফড়ণবীসকে উপমুখ্যমন্ত্রী করে এবং শিবসেনার বিদ্রোহী নেতা শিণ্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী করে এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন শাহ। একদিকে, শিণ্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী করে এক ধাক্কায় উদ্ধবের রাজনৈতিক কেরিয়ারে শেষ কফিন পোঁতার চেষ্টা করলেন। সেই সঙ্গে, ফড়ণবীসকে মুখ্যমন্ত্রীর জায়গায় উপ মুখ্যমন্ত্রী হতে একপ্রকার বাধ্য করে কার্যত তাঁর ডানা ছেঁটে দিলেন।


কারণ মহারাষ্ট্রে হাঁকডাকের পাশাপাশি, সম্প্রতি গোয়াতেও প্রয়াত মন্ত্রী তথা বিজেপি-র দীর্ঘ দিনের সদস্য মনোহর পর্রীকর ছেলেকে প্রার্থী করার ক্ষেত্রেও ফড়ণবীস ছড়ি ঘোরান বলে অভিযোগ সামনে আসে। তাতে বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হন মনোহর-পুত্র উৎপল। নির্বাচনের আবহে ফড়ণবীসকে নিয়ে কড়া পদক্ষেপ না করা গেলেও, তিনি যে বাড়াবাড়ি করছিলেন, এই পদক্ষেপেই তা বুঝিয়ে দেওয়া গেল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। ২০১৯ সালে শপথ নেওয়ার ৮০ ঘণ্টা পর উদ্ধবকে কুর্সি ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়া ফড়ণবীস এবং তাঁর স্ত্রীর আচরণও চোখে বেঁধে অনেকের। 



আরও পড়ুন: Eknath Shinde Profile: বিয়ার কারখানার কর্মী থেকে অটোচালক, সন্তানের মৃত্যু ভুলতে রাজনীতিতে ডুব, এ বার মুখ্যমন্ত্রী শিণ্ডে


এ নিয়ে ফড়ণবীসকে কটাক্ষ করেছেন কংগ্রেসের জাতীয় মুখপাত্র রোহন গুপ্তও। উদ্ধব পদত্যাগ করার পর বুধবার রাতে বিজেপি কর্মীরা মিলে ফড়ণবীসকে লাড্ডু খাইয়েছিলেন। সেই ছবি তুলে ধরে ট্যুইটারে রোহন লেখেন, 'ফড়ণবীশের লাড্ডু শিণ্ডের মুখে উঠল'। একই সঙ্গে ব্যঙ্গের সুরে তিনি লেখেন, 'অব কি বার, E-একনাথ, D-দেবেন্দ্র, সরকার,' অর্থাৎ 'ইডি' সরকার। 'লাড্ডু এ বারও বিশ্বাসঘাতকতা করল' বলেও লেখেন রোহন। 


বিদ্রোহ-পর্বেই শিণ্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী করে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে উদ্ধবের কাছে গিয়েছিলেন এসিপি প্রধান শরদ পওয়ার। শিণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ায়, এ দিন তাঁকে শুভেচ্ছাও জানান শরদ। শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান উদ্ধবও। তিনি এবং দেবেন্দ্র মহারাষ্ট্রের জন্য কাজ করবেন বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি। কিন্তু দেবেন্দ্রকে কটাক্ষ ছুড়ে দেন শরদ। তাঁর কথায়, " শিণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী হবেন এটা কল্পনা করা যায়নি।দেবেন্দ্র ফড়ণবীসকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তিনি খুশি নন। তাঁর চোখেমুখে সেটা ফুটে উঠছিল।"


বিজেপি যদিও পাল্টা যুক্তি সাজিয়েছে যে, তাদের দল ক্ষমতালোভী নয়। ফড়ণবীসকে মুখ্যমন্ত্রী না করা নিয়ে দলে কোনও গন্ডগোলও নেই। কিন্তু মহারাষ্ট্রে বিজেপি-র প্রত্যাবর্তনের গোড়াতেই যে গন্ডগোল কিছু বেঁধেছে, এ দিনের পর পর ঘটনাক্রমই তার প্রমাণ।  



মহারাষ্ট্রে বিজেপি-র সমর্থনে শিণ্ডের সরকার


একসময় উদ্ধবের হাতে শিবসেনার দায়িত্ব তুলে দেওয়ার প্রতিবাদ করে দল ছেড়েছিলেন শিবসেনা ছেড়েছিলেন বালাসাহেব ঠাকরের ভাইপো রাজ ঠাকরে। তাঁর তৈরি মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা এখনও মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিশেষ কোনও দাগ কাটতে না পারলেও, উদ্ধবের পতনের পর, নাম না করে তাঁকে কটাক্ষ করেছেন রাজ। পাশাপাশি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন শিণ্ডেকে। তাঁর কথায়, 'যখন কেউ সৌভাগ্যকে তাঁর ব্যক্তিগত কৃতিত্ব বলে মনে করে,পতনের দিকে যাত্রা শুরু হয়। মহারাষ্ট্রের মুখমন্ত্রী হিসেবে একনাথ শিণ্ডেকে অভিনন্দন। সতর্ক থাকুন। বুঝেসুঝে সিদ্ধান্ত নিন'।
শনিবার মহারাষ্ট্র বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দেবে শিণ্ডে এবং বিজেপি-র জোট সরকার। ওই দিনই বিধানসভার স্পিকার নির্বাচন।