নয়াদিল্লি: হনুমান মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা হোক বা নোটে লক্ষ্মী-গণেশের ছবি ছাপার প্রস্তাব, বিগত কয়েক মাসে আইআইটি-ফেরত অরবিন্দ কেজরিওয়ালের প্রতি পদক্ষেপই তীব্র সমালোচনায় পড়েছে। কিন্তু নেহাত আলটপকা মন্তব্য বা খবরে থাকার চেষ্টা নয়, বিজেপি-র বিকল্প হয়ে ওঠার লক্ষ্যেই যে এগোচ্ছে আম আদমি পার্টি, তার বিশ্লেষণ উঠে এসেছিল আগেই। ভোট-বিশ্লেষকদের জহুরি চোখ যে ভুল দেখেনি, তা প্রমাণ হয়ে গেল বুধবারই। কারণ দীর্ঘ ১৫ বছর দিল্লি পৌরসভায় একচেটিয়া আপ নিতে চলেছে আপ। 


বুধবার দিল্লি পৌরসভার অন্তর্গত ২৫০ ওয়ার্ডের ভোটগণনা শুরু হয়।  তার চার ঘণ্টার মধ্যেই বিজেপি-কে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় আপ। ঘড়ির কাঁটা দুপুর সাড়ে ১২টায় পৌঁছতে পৌঁছতে নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের জয়। ২৫০ ওয়ার্ডের মধ্যে অর্ধেকের বেশি জায়গাই আপের দখলে চলে এসেছে। এখনও পর্যন্ত ১৩৫ ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছে তারা। বিজেপি জিতেছে ১০১টি ওয়ার্ডে। মাত্র ১১টি ওয়ার্ডে জয়লাভ করেছে কংগ্রেস। তাই বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়ে দিল্লি পৌরসভা দখল করল আপ। আর তাদের সামনে কার্যতই ধরাশায়ী হল বিজেপি।


দিল্লি পৌরসভা নির্বাচন দখলে রাখতে এ বার প্রচেষ্টার খামতি ছিল না কোনও শিবিরেই। দিল্লি পৌরসভার পুনর্বিন্যাসও সেই রাজনৈতিক কৌশলেরই অঙ্গ ছিল বলে গোড়া থেকেই জানিয়ে আসছিলেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তবে বিজেপি গোড়া থেকে জয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকলেও, আপের পাল্লা যে ভারী, তার ইঙ্গিত মিলেছিল এ যাবৎ সামনে আসা প্রায় সব বুথফেরত সমীক্ষাতেই। তাই এ দিন গণনায় জয় একরকম নিশ্চিত হতেই দলের নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন কেজরিওয়াল। কেজরিওয়ালের বাসভবনেই চলছে ওই বৈঠক। সেখানে উপস্থিত রয়েছেন মণীশ সিসৌদিয়া, রাঘব চাড্ডা। এমনকি পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত সিংহ মানও বৈঠকে যোগ দিতে ছুটে এসেছেন। 


জয়ে আনুষ্ঠানিক সিলমোহর পড়া বাকি থাকলেও, আপ কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছে। দিল্লিতে আপের দলীয় কার্যালয় বেলুনে মুড়ে ফেলা হয়েছে। আগে থেকেই পোস্টার, ফেস্টুন তৈরি রাখা হয়েছিল। একে একে সেগুলিকে লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে। নীল-হলুদ আবির মাখতে শুরু করেছেন আপ সমর্থকরা। দিল্লি পৌরসভার এই ফলাফল আগামী দিনে রাজধানীর রাজনীতির গতিপথও পাল্টে দেবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ বিগত এক দশক দিল্লি পৌরসভার দখল ধরে রাখলেও, ২৪ বছর ধরে দিল্লি বিধানসভার দখল নিতে পারেনি বিজেপি। ২০১৫-র বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টিতে আপ জয়ী হলেও, তার দু'বছরের মাথাতেই দিল্লি পৌরসভায় জয়ী হয় বিজেপি।  আবার  আপ রাজধানীতে খুঁটি যত মজবুত করেছে, ততই শিকড় আলগা হয়েছে কংগ্রেসের। 


তবে বিজেপি-র কাছ থেকে দিল্লি পৌরসভা ছিনিয়ে নেওয়ার নেপথ্যে কেজরিওয়ালের রাজনৈতিক কৌশলই কাজ করছে বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। কারণ পঞ্জাবে ক্ষমতাদখলের পর গুজরাত এবং হিমাচলপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনেও নাম তুলেছে আপ। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে এই মুহূর্তে জাতীয় দলের তকমা পাওয়াই প্রধান লক্ষ্য় তাদের। সেই লক্ষ্যপূরণে বিজেপি-কে তাদের নিজেদের অস্ত্রেই ঘা.য়েল করতে চাইছে আপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংখ্যালঘু ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা নেই জেনেই বিজেপি-র বিকল্প হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছে আপ। তার জন্যই প্রকাশ্যে হনুমান ভক্তি, হনুমান চালিশা পাঠ এবং টাকায় লক্ষ্মী-গণেশ ছাপার মতো প্রস্তাব দিতে পিছপা হননি কেজরিওয়াল। তার ফলও মিলেছে হাতেনাতে। আইআইটি-ফেরত কেজরিওয়াল, যিনি কয়েক দিন আগে পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যকে এগিয়ে রেখে ভোটপ্রার্থনা করেছেন, তাঁর এমন ভোলবদল বিজেপি-র কাছেও ছিল অতর্কিত। তাই তারা ধাতস্থ হওয়ার আগেই কাজ গুছিয়ে নিয়েছে আপ। 


তবে শুধু বিজেপি-কে মাত দেওয়াই নয়, আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতিতেও আপের উত্থান আরও জোর পাবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-কে বাদ দিয়ে তৃতীয় বিরোধী জোটের পক্ষে বহু দলই। কিন্তু সেখানেও প্রতিযোগিতা রয়েছে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কে চন্দ্রশেখর রাও এবং কেজরিওয়ালের মধ্যে। তাই বিজেপি-র বিকল্প হয়ে ওঠার পাশাপাশি, বিরোধী শিবিরের ভরসা হয়ে ওঠাও লক্ষ্য কেজরিওয়ালের। সেই লক্ষ্যপূরণে পঞ্জাব যদি প্রথম ধাপ হয়ে থাকে, তাহলে দিল্লি পৌর নির্বাচন তাঁকে আরও এগিয়ে দিতে মইয়ের কাজ করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।