চণ্ডীগড়: মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন একমাসও হয়নি। তার মধ্যেই রাজধানী নিয়ে টানাপোড়েনে পা রাখলেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত সিংহ মান (Bhagwant Mann)। চণ্ডীগড়কে পাঞ্জাবের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি রাখলেন তিনি। শুক্রবার এই মর্মে পাঞ্জাব বিধানসভায় প্রস্তাবও পাশ হয়ে গিয়েছে। তাতে কেন্দ্রের বিজেপি (BJP) সরকারের বিরুদ্ধে এককাট্টা রাজ্যে ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টি (Aam Aadmi Party/AAP), কংগ্রেস (Congress) এবং শিরোমণি অকালি দল (Shiromani Akali Dal)।
কেন্দ্রের সঙ্গে চরমে সংঘাত
ভগবন্তের জানিয়েছেন, ১৯৬৬ সালের পঞ্জাব পুনর্গঠন আইন অনুযায়ী, চণ্ডীগড়ের উপর অধিকার নিয়ে এ যাবৎ পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং হিমাচল প্রদেশের মধ্যে ভারসাম্য বজায় ছিল। কিন্ত কেন্দ্রীয় সরকার সেই ভারসাম্য নষ্ট করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না। চণ্ডীগড় নিয়ে কোনও রকম আপসে যাবে না পঞ্জাব। তাই এ নিয়ে কোনও প্রশ্নের অবকাশ নেই। চণ্ডীগড়কে পঞ্জাবের হাতে তুলে দিতে হবে বলে মত ভগবন্তের। পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই কেন্দ্রীয় সরকার স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে মত কংগ্রেস এবং অকালি দলেরও। এর আওতায় আগামী দিনে পঞ্জাব জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এখন থেকে চণ্ডীগড়ে কেন্দ্রীয় আইন বলবৎ হবে বলে সম্প্রতি ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah)। তাতেই বহু দশক ধরে চলে আসা বিতর্কের আগুনে ঘৃতাহুতি পড়েছে। কারণ এতকাল পঞ্জাব সরকারের আইনই কার্যকর ছিল সেখানে, যার আওতায় চণ্ডীগড়ে সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়স ছিল ৫৮ বছর। নতুন মায়েরা এক বছরের মাতৃত্বকালীন ছুটি পেতেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় আইনের আওতায় সেখানে অবসরের বয়স বাড়িয়ে ৬০ বছর এবং দু’বছরের মাতৃত্বকালীন ছুটির ঘোষণা করেন শাহ। আগামী অর্থবর্ষ থেকেই এই নিয়ম কার্যকর হবে বলে জানান।
পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর পর শাহের এই ঘোষণা ঘিরে সংঘাত চরম আকার ধারণ করেছে। আপ, কংগ্রেস এবং অকালি দলের দাবি, ২০২৪-এ লোকসভা এবং পরে হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচন। পঞ্জাবে হারের পর এখন চণ্ডীগড়বাসীর সমর্থন ধরে রাখতে মরিয়া বিজেপি। বর্তমানে হরিয়ানায় তাদেরই সরকার রয়েছে। তাই প্রলোভন দেখিয়ে ভোটবাক্সে সমর্থন ভর্তি করাই তাদের লক্ষ্য। যদিও বিজেপি-র দাবি, এই সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধি নেই। এর আগে, ১৯৯২ সালেও চণ্ডীগড়ের সরকারি কর্মীদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।
পঞ্জাব পুনর্গঠন আইন ১৯৬৬
১৯৫২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং হিমাচল প্রদেশের মানচিত্রে বেশ কিছু রদবদল ঘটানো হয়। এর আওতায় পঞ্জাবের থেকে হরিয়ানাকে আলাদা করে দিলেও চণ্ডীগড় পঞ্জাবের রাজধানীই থেকে যায়। ১৯৬৬ সালে পঞ্জাব এবং হরিয়ানা দু’টি পৃথক রাজ্য গঠিত হয়। কিছু অংশ যুক্ত হয় হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে। সেই থেকে পঞ্জাব এবং হিরয়ানা, দুই রাজ্যেরই রাজধানী হিসেবে গন্য হয়ে আসছে চণ্ডীগড়। চণ্ডীগড় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়। কিন্তু ১৯৬৬ সালের পঞ্জাব পুনর্বিন্যাস আইন অনুযায়ী, চণ্ডীগড়ের প্রশাসনিক কাজকর্ম পঞ্জাবের হাতেই থাকে। অবিভক্ত পঞ্জাবের আইনই কার্যকর হয় চণ্ডীগড়ে। মোট সম্পত্তি পঞ্জাব এবং হরিয়ানার মধ্যে ৬০:৪০ অনুপাতে ভাগ করে দেওয়া হয়।
ওই সময়ই গঠিত হয় বখরা বিয়াস ম্যানেজমেন্ট বোর্ড। ১৯৬০ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী, ইরাবতী, বিপাশা এবং শতদ্রু নদীর জলের অধিকার পায় ভারত। সিন্ধু, ঝিলম এবং চন্দ্রভাগার জলের অধিকার পায় পাকিস্তান। পঞ্জাব ভাগের পর পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, দিল্লি এবং রাজস্থানের মধ্যে জলের বণ্টণের জন্য গঠিত হয় বিশেষ বোর্ড, পরবর্তী কালে যার নামকরণ হয় বখরা বিয়াস ম্যানেজমেন্ট বোর্ড। এই বোর্ডের চেয়ারপার্সন এবং দুই স্থায়ী সদস্য পঞ্জাব এবং হরিয়ানার প্রতিনিধি। এ ছাড়াও রাজস্থান, হিমাচল সরকারেরও এক জন করে প্রতিনিধি রয়েছেন। বোর্ডের মোট সদস্য কর্মিসংখ্যা ১২ হাজার, এর মধ্যে ৬৯৬ জন শরিক রাজ্যগুলির নাগরিক।
কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকার যে বিজ্ঞপ্তি জারি করে, তাতে বলা হয় যে, বোর্ডের স্থায়ী সদস্য শুধুমাত্র পঞ্জাব বা হরিয়ানার নাগরিক হবেন, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তেরও তীব্র বিরোধিতা শুরু হয়েছে। পঞ্জাবের জলের বরাদ্দে হস্তক্ষেপ করতেই এমন সিদ্ধান্ত বলে অভিযোগ আপ। তাদের দাবি, পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র দু’টি আসন পেয়েছে বিজেপি। চণ্ডীগড় পুরসভা নির্বাচনেও ৩৫টি আসনের মধ্যে আপ যেখানে ১৪টিতে জয়ী হয়েছে, ১২টি পেয়েছে বিজেপি। আগের নির্বাচনে যদিও ২০টি আসন থেকে অনেকটাই নীচে নেমে গিয়েছে তারা। তাই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন এবং হরিয়ানা নির্বাচনকে মাথায় রেখেই কেন্দ্রশাসিত চণ্ডীগড়বাসীকে বিজেপি প্রলোভন দিচ্ছে বলে অভিযোগ আপের।
এর আগে, ১৯৮৫ সালে স্বাক্ষরিত রাজীব-লংওয়াল চুক্তি অনুযায়ীস ১৮৮৬ সালের ২৬ জানুয়ারি চণ্ডীগড়কে পঞ্জাবের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পিছু হটে তৎকালীন রাজীব গাঁধী সরকার। হরিয়ানার তরফেও চণ্ডীগড়ের বিভাজনের প্রস্তাব ওঠে, কিন্তু খাতায় কলমে তা আর পৌঁছয়নি। ২০২০ সালে হরিয়ানা বিধানসভায় একটি প্রস্তাব পাশ হয়, যার আওতায় পঞ্জাবের দখলে থাকা চণ্ডীগড়ের একটি সরকারি ভবনে ২০টি ঘরের দাবি তোলে তারা। বর্তমানে চণ্ডীগড়ের ক্যাপিটল সিটি কমপ্লেক্সে দুই রাজ্যেরই পৃথক কক্ষ রয়েছে। পঞ্জাবের তরফে চণ্ডীগড়ের উপর পূর্ণ অধিকারের দাবি খারিজ করেছেন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর।