আগামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী জো বিডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসের নাম ঘোষণা করেছেন। অনেকে মনে করছেন, ‘পরিচিতিসত্ত্বার রাজনীতি’-র কথা মাথায় রেখেই কমলাকে বেছে নিয়েছেন বিডেন। যদিও অনেকে আবার এর সঙ্গে একমত নন। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে বরাবরই ভারসাম্যের রাজনীতি হিসেবে দেখা হয়। এক্ষেত্রে বিডেন একজন মহিলাকে টিকিট দেওয়ার না দেওয়ার মতো অভদ্রতা করেননি। বিশেষ করে তাঁর যখন বয়স হয়ে গিয়েছে, দলের কাছে অতীত হয়ে গিয়েছেন, তাঁর চেহারা বা কথাবার্তাও তেমন আকর্ষণীয় নয়, তখন কমলাকে বেছে নিয়ে বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করেছেন বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ, কমলাই দলের ভবিষ্যৎ। তাঁর চেহারা ও কথাবার্তা আকর্ষণীয়, তাঁর বয়স তুলনামূলকভাবে কম, বিডেন যেখানে পূর্ব উপকূলের, সেখানে কমলা পশ্চিম উপকূলের। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হল, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন, প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন এবং প্রথম মহিলা হিসেবে স্যান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হন। পরবর্তীকালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হন তিনি। এরপর প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন মহিলা হিসেবে সেনেটের সদস্য নির্বাচিত হন কমলা। প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের কোনও একটির ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেন তিনি।


কমলার আরও অনেক কৃতিত্ব এবং গুণই আছে, কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার সেসব খুব একটা প্রয়োজন নেই। কারণ, এখনও পর্যন্ত যাঁরা ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কোনও গুণই ছিল না। যদি না ছল, কপটতা এবং খাঁটি মাদকতাকে জীবনে উন্নতি এবং সম্মান অর্জনের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়। তবে আমার ব্যক্তিগত মত, একজন ব্যক্তি নৈতিকভাবে কতটা এগিয়ে বা কতটা শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান বা বুদ্ধিমতী, ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য সেটা জরুরি নয়। নিষ্ঠুর সত্য হল, কমলা যে সমস্ত পদে আছেন, সেগুলি নিয়ে এখনও পর্যালোচনা করা হয়নি। বরং তিনি যে ‘অ-শ্বেতাঙ্গ মহিলা’ এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং আংশিকভাবে আফ্রিকান আমেরিকানদের নিজেদের লোক, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনীতম প্রদেশের পুলিশ বিভাগের প্রধান এবং আইনজীবী হিসেবে কমলার রেকর্ডের সঙ্গে সবসময় পরিচিতিসত্ত্বার প্রশ্ন ঘোরাফেরা করেছে। তিনি কি নিজেকে সবসময় কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে পরিচয় দেন এবং শুধু প্রয়োজনের সময়ই নিজের ভারতীয় পরিচিতির কথা উল্লেখ করেন? প্রচার যত এগোবে, তিনি কি তত বেশি নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে তুলে ধরবেন? তিনি হয়তো নিজের আংশিক ভারতীয় পরিচয় তুলে ধরতে পারেন, তবে এটা কি তাঁর মাথায় থাকবে যে মার্কিন রাজনীতিতে তাঁর ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ভূমিকা অনেক বেশি থাকবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা ৪০ লক্ষ। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ১.২৫ শতাংশ। অন্যদিকে, কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নাগরিকের সংখ্যা ১৪ শতাংশ। তবে ডেমোক্র্যাটদের প্রচারে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের যুক্ত করার সুবিধা হল, তাঁরা শিক্ষিত ও ধনী। অনেকে সেই কারণে বলছেন, ধনবান ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকদের কাছ থেকে ভোট ও ডোনেশন আদায় করার জন্য ভারতীয় পরিচয়কে আরও বেশি করে তুলে ধরবেন? অনেকে আবার এমনও বলছেন, নিজেকে শুধু মার্কিন হিসেবে তুলে ধরার জন্য কমলা কি সমানভাবে তাঁর ভারতীয় ও কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয় তুলে ধরবেন?

তবে কমলার সমর্থকরা বলছেন, তিনি মার্কিন স্বার্থেই কাজ করবেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইজরায়েল বিষয়ক নীতিকে সমর্থন করেন। কলিন পাওয়েল, কন্ডোলিজা রাইস, বারাক ওবামা যেভাবে শ্বেতাঙ্গ মার্কিন নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই কাজ করেছেন, ঠিক সেভাবেই কাজ করবেন কমলা। তাঁর বাবার সঙ্গে পাঁচ বছর বয়সেই মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তাঁর মা তাঁকে মানুষ করলেও, কোনওদিনই কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হননি কমলা। যদিও তাঁর উপর মায়ের প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই বেশি। তবে নিজের কৃষ্ণাঙ্গ পরিচিতি নিয়ে গর্বিত কমলা। তিনি নিজেকে আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে তুলে ধরেন। তবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকরা, বিশেষ করে মহিলারা কমলাকে নিয়ে গর্বিত হতেই পারেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সব আলোচনাতেই পরিচিতিসত্ত্বার রাজনীতির কথা শোনা যায়। সেটা যাঁরা বুঝতে পারেন না, তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছুই বোঝেন না। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমলা দেবী হ্যারিসের মনোনয়ন মার্কিন জনজীবনে পরিচতিসত্ত্বার রাজনীতির প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারবে না। তাঁকে যদি আফ্রিকান আমেরিকান হিসেবে ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে তাঁর মা ভারত থেকে একজন বিদেশি ছাত্রী হিসেবে এসেছিলেন। তাঁর বাবা আবার জামাইকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। বার্কলেতে পড়ার সময় তাঁদের আলাপ হয়। নাগরিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনে তাঁরা একসঙ্গে সামিল হন। ‘উন্নয়নশীল বিশ্বে’ স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করেন তাঁরা। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হওয়ার পর মায়ের সঙ্গে থাকলেও, কমলা নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই পরিচয় দিয়ে এসেছেন। তিনি সবসময় বাবার কথা বলেছেন। নিজেকে ভারতীয় হিসেবে সেভাবে তুলে ধরেননি। ফলে কমলা ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের গুরুত্ব বাড়বে? সেটা নিয়েই ভাবছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা।

মতামত একান্তভাবেই লেখকের ব্যক্তিগত। এর সঙ্গে এবিপি আনন্দের সম্পাকদীয় নীতির কোনও সম্পর্ক নেই।