তেহরান: বেঁচে থাকলেও থাকতে পারেন বলে এতক্ষণ আশায় ছিলেন সকলে। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার ১২ ঘণ্টা পর ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসিকে মৃত বলে ঘোষণা করা হল।  রবিবার হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার ১২ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। সোমবার সকালে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হেলিকপ্টারটির খোঁজ মেলে। গোড়াতেই উদ্ধারকারীরা জানান, হেলিকপ্টারের কোনও যাত্রীর জীবিত থাকার কোনও ইঙ্গিত নেই। এর পর রইসির মৃত্যুর ঘোষণা হয়। (Ebrahim Raisi Killed) তাঁর মৃত্যুতে দেশে পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা হয়েছে। 


ইরানের আধা  সরকারি সংবাদমাধ্যম Mehr জানিয়েছে, হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে রইসির। কর্তব্যরত অবস্থায় থাকাকালীন রইসি এবং তাঁর বিদেশমন্ত্রী 'শহিদ' হয়েছেন বলে জানিয়েছে তারা। (Ebrahim Raisi Helicopter Crash) রইসির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ শাসক আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। তিনি লেখেন, 'গভীর বেদনা এবং আফশোস সহকারে মানুষের প্রেসিডেন্ট, পরিশ্রমী হজ সৈয়দ ইব্রাহিম রইসি এবং তাঁর সহযোগীদের মৃত্যু সংবাদ পেলাম। মানুষের সেবায় নিযুক্ত থাকাকালীনই ওঁর এমন মর্মান্তিক পরিণতি হল। বলিদানের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতেন উনি, একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেও মানুষ এবং ইসলামের সেবা করে গিয়েছেন'।


ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন,  'ইরানের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ ইব্রাহিম রইসির মৃত্যুতে অত্যন্ত দুঃখিত এবং স্তম্ভিত। ভারত-ইরান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করে তোলার ক্ষেত্রে ওঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওঁর পরিবার, ইরানের নাগরিককে সমবেদনা জানাই। এই কঠিন সময়ে ভারত ইরানের পাশে রয়েছে'। ভারতে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা হয়েছে।




রবিবার রাতে ইরানের উত্তর-পশ্চিমে, আজেরবাইজান সীমান্তের কাছে পার্বত্য এলাকায় ভেঙে পড়ে রইসির হেলিকপ্টার। রইসি ছাড়াও কপ্টারে ছিলেন দেশের বিদেশমন্ত্রী হোসেন আমিরাবদোল্লাহিয়ানও।  সীমান্ত এলাকায় সফর সেরে ফিরছিলেন তাঁরা। সেই সময় জোলফা পার্বত্য অঞ্চলে, একটি তামার খনির কাছে হেলিকপ্টারটি ভেঙে পড়ে বলে জানা গিয়েছে।উড়ানের আধ ঘণ্টা পর থেকেই হেলিকপ্টারটির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তার পরই আশঙ্কা মাথাচাড়া দেয়। ঘন কুয়াশার জন্যই আমেরিকার তৈরি Bell 212 কপ্টারটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে। ইরানের উত্তর-পূর্বে মাশাদ শহর, যা কি না রইসির জন্মস্থান, সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে বলে জানা গিয়েছে।



সেই থেকে দুর্ঘটনাগ্রস্ত কপ্টারটির খোঁজ চলছিল। অবশেষে ১২ ঘণ্টা পর, সোমবার সকালে পার্বত্য এলাকায় দুর্ঘটনাগ্রস্ত কপ্টারটির খোঁজ মেলে। ইরানের বেসরকারি মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা Red Crescent-ও উদ্ধারকার্যে যুক্ত ছিল। ওই সংস্থার প্রধান, পীর হোসেন কোলিবন্দ জানান, দূর থেকেই হেলিকপ্টারটির ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে। যে ভাবে সেটি ভেঙে পড়েছে, তা মোটেই ভাল ঠেকছে না। হেলিকপ্টারের কোনও সওয়ারির বেঁচে থাকার তেমন কোনও ইঙ্গিতই নেই। 



জানা গিয়েছে, হেলিকপ্টারের কেবিনটি অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে প্রায়। এখনও পর্যন্ত দুর্ঘটনাস্থলে, হেলিকপ্টারের ভিতরে বা বাইরে কারও বেঁচে থাকার কোনও ইঙ্গিত পাননি উদ্ধারকারীরা। এই প্রথম এমন পরিস্থিতিতে পড়ল ইরান, যেখানে প্রেসিডেন্ট আদৌ বেঁচে আছেন কি না, সেই নিয়ে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা ছিল প্রায় ১২ ঘণ্টা। তাই সরকার বিরোধীদের মধ্যেও নীরবতা লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেকেই প্রেসিডেন্টের হালহকিকত জানতে উৎসুক হয়ে ছিলেন। 


রইসির খোঁজে তুরস্ক, রাশিয়া এগিয়ে আসে। উদ্ধারকারী  দল, ড্রোন এবং অন্যান্য সরঞ্জাম পাঠিয়েছে তারা। সৌদি আরব, কাতার, ইরাক, কুয়েতও ইরানের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে। তুরস্কের ড্রোনই প্রথম হেলিকপ্টারটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়। সবমিলিয়ে ৭৩টি উদ্ধারকারী দল হেলিকপ্টার এবং রইসির সন্ধানে নামে গতকাল রাতেই। এখনও পর্যন্ত যা খবর, তাতে রইসির মৃত্যুতে ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে পারেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মোখবার। তবে এক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ শাসক আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। 


তাই রইসির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যখন ক্ষীণ হয়ে আসছিল, তিনি চলে গেলে কে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছিল। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পিছনে যদিও কোনও রকম সন্দেহজনক কিছু মেলেনি এখনও পর্যন্ত, তবে রইসির অবর্তমানে দেশে ক্ষমতাদখল নিয়ে চরম অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে কূটনৈতিক মহল। 




আমেরিকায় বারাক ওবামার আমলে স্টেট ফর হাউস বিভাগের অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি পদে থাকা জোয়েল রুবিন এ নিয়ে মুখ খুলেছেন সংবাদমাধ্যমে। তিনি জানিয়েছেন, রইসি এবং তাঁর সহযোগীদের মৃত্যুর নেপথ্য়ে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব এখনই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আগামী দিনে এই ঘটনা ইরানের রাজনীতি তো বটেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে চলেছে। 


রুবিন জানিয়েছেন, ইরানের সর্বোচ্চ শাসক আয়াতোল্লা খোদ রইসিকে বেছে নিয়েছিলেন। শুধুমাত্র প্রসিডেন্ট হিসেবেই নন, আক্ষরিক অর্থেই আয়াতোল্লা নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রইসি, যাতে তাঁর অবর্তমানে ইরানের সবকিছু রইসির অঙ্গুলিহেলনেই পরিচালিত হয়। সেই রইসির মৃত্যুতে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করবে।


পশ্চিম এশিয়া এবং আমেরিকার বিদেশ নীতি নিয়ে গবেষণা করে বই লিখেছেন ত্রিতা পার্সি। তাঁর মতে, রইসির মৃত্যুতে ভাইস প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপতির পদে উন্নীত হবেন। কিন্তু তার পরও ৫০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করাতে হবে, যা মোটেই সহজ কাজ হবে না। কারণ সরকার বিরোধী অবস্থান চরম আকার ধারণ করেছে দেশে। সম্প্রতি যে সংসদীয় নির্বাচন হয়, তাতে ভোটই দিতে যাননি মানুষজন। আর দুর্ঘটনার নেপথ্যে যদি সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে, তাতেও অশান্তি ছড়াতে পারে। ইরানের সর্বোচ্চ শাসক আয়াতোল্লার উত্তরসূরি রইসিকে সরানোর ষড়যন্ত্র কে বা কারা রচনা করেছেন, সেই নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হবে, যা হিংসাত্মক আকারও ধারণ করতে পারে। 


যে কারণে এই মুহূর্তে অত্যন্ত সাবধানী অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে আমেরিকাকে। রইসিকে নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি তারা। তবে রইসি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছেন বলে খবর পৌঁছনোর পরই আধিকারিকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। পেন্টাগন পরিস্থিতির দিকে নজর রেখেছে।