কলকাতা : ভয়াবহ করোনা-আতঙ্ককে নিয়ন্ত্রণে এনে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল রাজধানী। বহু দিন পর খুলেছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু, মাত্রাছাড়া মাত্রায় পৌঁছে যায় দূষণ। আর তার জেরে ফের বন্ধ করে দেওয়া হয় দিল্লির সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আপাতত পড়াশোনা অনলাইনে হবে, গত মঙ্গলবার রাতে এই মর্মে নির্দেশিকা জারি করে কমিশন ফর এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট। আর তার পর থেকেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে কলকাতাকে নিয়েও।


কেন এই আশঙ্কা ?


'সৌজন্যে' সেই দূষণ। করোনা পরিস্থিতিতে (Covid-19) দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল রাজ্যের স্কুল-কলেজগুলি। গত ১৬ নভেম্বর দীর্ঘদিন পর খুলেছে রাজ্যের স্কুল (School), কলেজ (College), বিশ্ববিদ্যালয়ের(University) গেট। প্রথমদিনেই ছিল নজরকাড়া উপস্থিতি। এদিকে কলকাতার আকাশেও উদ্বেগজনক দূষণ-মাত্রা চিন্তা বাড়াচ্ছে। 


সম্প্রতি এমনই একটি তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, যা চিন্তা বাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট। বাতাসের গুণগত মানের নিরিখে সবথেকে খারাপ অবস্থায় থাকা দশটি শহরের মধ্যে -কলকাতা। ভারত থেকে ঢুকে পড়ে তিনটি শহর- দিল্লি, কলকাতা ও মুম্বই। সুইৎজারল্যান্ডের একটি সংস্থা IQAir বাতাসের গুণগত মান ও দূষণের মাত্রা ট্র্যাক করে এই তথ্য প্রকাশ করেছিল( প্রসঙ্গত, UNEP (United Nations Environmental Program)-এর প্রযুক্তি-সঙ্গী IQAir)। এই তালিকায় সবথেকে শীর্ষে দেখা যায় দিল্লিকে। এখানকার বাতাসের গুণগত সূচক বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স(AQI) ছিল ৫৫৬। কলকাতা ও মুম্বইয়ের AQI ছিল যথাক্রমে ১৭৭ ও ১৬৯। তালিকায় চতুর্থ ও ষষ্ঠ স্থানে ছিল এই দুই শহর। এছাড়া এই তালিকায় ঢুকে পড়ে পাকিস্তানের লাহোর ও চিনের চেঙ্গড়ু।


প্রথম দশে কোন শহরগুলি থেকেছে সেই তালিকায় দেখে নেওয়া যাক


দিল্লি, ভারত(AQI: 556)
লাহোর, পাকিস্তান(AQI: 354)
সোফিয়া, বুলগেরিয়া(AQI: 178)
কলকাতা, ভারত(AQI: 177)
জ্যাগরেব, ক্রোয়েশিয়া(AQI: 173)
মুম্বই, ভারত(AQI: 169)
বেলগ্রেড, সার্বিয়া(AQI: 165)
চেঙ্গুড়, চিন(AQI: 165)
স্কোপজে, উত্তর ম্যাসেডনিয়া(AQI: 164)
ক্র্য়াকো, পোল্যান্ড(AQI: 160)


এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত গণ্য করা হয় "ভাল" হিসেবে, ৫১-১০০ "সন্তোষজনক", ১০১-২০০ "সহনীয় বা মাঝারি", ২০১-৩০০ "খারাপ", ৩০১-৪০০ "খুব খারাপ" এবং ৪০১-৫০০ "মারাত্মক"।


উপরোক্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী AQI-এর নিরিখে দেখলে "মাঝারি" অবস্থায় কলকাতা। সামনে আর তিন ধাপ। অর্থাৎ একটু গাছাড়া দিলেই বিগড়ে যেতে পারে পরিস্থিতি, এমনই আশঙ্কা পরিবেশবিদদের অনেকের। উৎসবরে মরসুমে বিশেষ করে কালীপুজোর দু’দিন পরেই তার একটা ঝলক দেখা গিয়েছিল কলকাতার দূষণমাত্রায়। কালীপুজোর দু'দিন পর বাতাসে দূষণের পরিমাণের খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবে কলকাতার বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাপ - PM10 থাকার কথা, ১০০ মাইক্রোগ্রাম পার মিটার কিউব এবং শ্বাসবাহিত ধূলিকণা অর্থাৎ PM2.5 থাকার কথা ৬০ মাইক্রোগ্রাম পার মিটার কিউব। কিন্তু, সেই সময় বাতাসে দূষণের পরিমাণ ছিল এর থেকে বেশি। দূষণ মাপার যন্ত্রে দেখা যায়, ওইদিন সেখানে PM10 ছিল ১০০ থেকে ১১৬ মাইক্রোগ্রাম এবং PM2.5 ছিল ৯২ মাইক্রোগ্রাম। সেইসময় পরিবেশবিদ সৌমেন্দ্র মোহন ঘোষ বলেছিলেন, এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, এরপর আমরা না আটকালে দিল্লির দিকে এগোচ্ছে।


তার পর অবশ্য গেছে ছটপুজো। যার জন্য আগে থেকে সতর্কতা নেয় প্রশাসন। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের (National Green Tribunal Kolkata) নির্দেশে দূষণ রুখতে ছট পুজোর আগে বন্ধ করে দেওয়া হয় রবীন্দ্র সরোবর (Rabindra Sarabar) ও সুভাষ সরোবর (Subhash Sarabar)। বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় দুই সরোবরের চারদিক।


এই পরিস্থিতিতে কোথায় দাঁড়িয়ে কলকাতা ? গত কয়েক ঘণ্টার চিত্রটাও খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই শহরের। গত ২৪ ঘণ্টার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কলকাতার একিউআই ছিল ২২৯। অর্থাৎ "খারাপ"(দিল্লির পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আর তার পরেই আপ নেতৃত্বাধীন সরকার নির্মাণকাজের ওপর থেকে লাগু থাকা সাময়িক নিষেধাজ্ঞার নির্দেশ তুলে নেয়। এই পরিস্থিতিতে আগামী ২৯ নভেম্বর থেকে রাজধানীতে স্কুল, কলেজ, লাইব্রেরি খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দিল্লির পরিবেশমন্ত্রী গোপাল রাই। যদিও আজ সুপ্রিম কোর্টের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাজধানীতে বায়ুর গুণগতমানের যে সঙ্কট তারজন্য বৈজ্ঞানিক মডেল তৈরি করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি পরিসংখ্যান ভিত্তিক মডেল তৈরির পরামর্শ দেয় শীর্ষ আদালত। এমনকী বায়ু দূষণ সংক্রান্ত মামলা এখনই বন্ধ করা হবে না বলে অ্যাপেক্স কোর্টের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী শুনানি হবে ২৯ নভেম্বর। তবে মুম্বইয়ের পরিস্থিতির বেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গতকালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখানকার বাতাসের গুণগত মান ছিল "সন্তোষজনক" অবস্থায়। বা, একিউআই ৭৬।)


সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের (Central Pollution Control Board) এর আগের বুলেটিন অনুযায়ী, দূষণের নিরিখে ভারতের ১১টি শহর 'Very Poor', অর্থাৎ 'খুব খারাপ' ক্যাটেগরিতে । এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের একটি শহরকে পাওয়া যা। বাকি ১০টি শহরই বিহারের। অর্থাৎ বায়ু দূষণের জ্বালা লেগেই রয়েছে।


এই পরিস্থিতিতে কলকাতার সামগ্রিক দূষণ-চিত্র নিয়ে পরিবেশবিদ নব দত্ত বলছেন, "প্রতি বছরই এই চার-পাঁচ মাস ধরে এটা চলে। সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত চলবে। যেমন-দীপাবলির সময় ৫০০-র ওপরে চলে গিয়েছিল একিউআই। গোটাটাই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। যাদবপুরের দিকে 'সিভিয়র' অবস্থা ছিল। দিল্লিতে এতদিন ধরে সরকার বলে গেল, পাঞ্জাব, হরিয়ানায় ফসল ওঠার সময় তার গোড়াটা পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য এমনটা হচ্ছে। আমাদের এখানে গতবার কোভিডজনিত কারণে দূষণ কম ছিল। কিন্তু, ২০১৯ সাল নাগাদ পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। এখানে বলা হত, ইটারি থেকে কাঠ-কয়লাজনিত ধোঁয়ার কথা। কিন্তু, এখানে গাড়ির দূষণ, দ্বিতীয়ত নির্মাণ শিল্পের দূষণ। এগুলো নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে কলকাতার অবস্থা দিল্লির থেকেও খারাপ। বারবার একথা বলছি। কারণ, দিল্লিতে যে ধরনের মাথাপিছু খোলা জমির পরিমাণ তার থেকে জনঘনত্ব অনেক বেশি কলকাতায়। মাথাপিছু ১৮ শতাংশ খোলা জমি আছে দিল্লিতে, সেখানে আমাদের এখন ৭ শতাংশ। ফলে, এখানে জনঘনত্ব অনেক বেশি। তবে, শুধু কলকাতা নয়, পশ্চিমবঙ্গের একাধিক শহরে এই সমস্যা রয়েছে। এটাকে মেনে নিতে হবে। কেন নির্মাণশিল্প যথেচ্ছচার করবে ? যে সমস্ত নির্মাণ হয়, সেখানে তো কোনও কিছু মানাই হয় না। কেন জঞ্জাল পোড়ানো হবে ? অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চলছে। বিশেষ করে ডিজেল গাড়ি। ভারতের অন্যান্য শহরের তুলনায় কলকাতায় ডিজেল গাড়ি বেশি। এটাকে ডিজেল ক্যাপিটল বলে। ডিজেল থেকে দূষণটা ছড়ায়।"