কলকাতা: সালটা ২০১৬। চারিদিকে দিনের আলো খটখটে। শুনশান রাস্তা। কোলে ছোট্ট মেয়েক নিয়ে ডাক্তারখানার পথে একটি মেয়ে। হঠাৎ পিছন থেকে এসে পড়ল গরম তরল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁর মনে হল কেউ আগুন দিয়ে দিয়েছে তার পিঠে। জ্বলতে শুরু করল নেটের ব্লাউজ। চামরা গলে ভিতরে ঢুকে গেল। মা....মা... বলে চিৎকার করতে করতেই থাকলেন মেয়েটি। কোল থেকে পড়ে গেল একরত্তি মেয়ে। পাগলের মতো তিনি তখন দৌড়চ্ছেন  একদিক থেকে আরেকদিক। কোথায় কোথায় একটু জল। সামনেই ছিল পুকুর। জ্বালা থেকে বাঁচতে সোজা ঝাঁপ দিলেন তিনি। তবুও কষ্ট কমছে না। কী করেই বা কমবে, ওটা তো অ্যাসিড। যা এক মুহূর্তে ঝলসে দিতে পারে শরীর, পুড়িয়ে দিতে পারে রঙিন জীবনের ক্যানভাস। 




কাকলি দাস। ২০ র কোঠার তরুণীর জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছিল অ্যাসিড হানা। অপরাধ? 'ছেলেটাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।' শুধুমাত্র এই কারণেই আমতলার বাসিন্দা কাকলির মুখটা জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিল সেই দুষ্কৃতী। 


'মনে হয়েছিল, আর বাঁচব না। আশাও ছিল না। ভেবেছিলাম, যদি আমার কিছু ঘটেও যায়... বাচ্চাগুলো তো বাঁচুক' বলতে বলতে গলা ধরে আসছিল কাকলির। অ্যাসিডে জ্বলে যাওয়া শরীরেই কোনওক্রমে রিকশা করে ফিরেছিলেন বাড়িতে। সেদিনটাও এক পয়সাও ছাড়েনি রিকশাওয়ালা। যন্ত্রণায় ছটপট করতে থাকা মেয়েটার থেকেই ভাড়া আদায় করেছিল সে। 


এরপর হাসপাতালের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলো। এয়ার কন্ডিশন করা ওয়ার্ডে তবু কিছুটা স্বস্তি ছিল। তারপর সেই অপারেশন। শরীরের অন্য অংশের চামড়া কেটে জুড়ে দিতে হয়েছিল ঝলসে যাওয়া পিঠে। ড্রেসিংয়ের সময় আর্ত চিৎকার করে  উঠতেন কাকলি। মনে হত, আর বাঁচবেন না। 


বাড়িতে ফিরে নিজের চেহারার দিকে তাকাতে পারেননি কাকলি। প্রতিবেশীদের নিন্দেমন্দও শুনতে হত অহরহ। 'নিশ্চয়ই ওর কোনও দোষ আছে, নইলে ওর সঙ্গেই বা এমন হবে কেন'। তবু ছোট্ট ছেলেটাই মনে ভরসা জোগাত 'মা ছাড় তো ওর কথা।' পাশে পেয়েছিলেন তাঁর স্বামীকেও। 




অবশেষে যোগাযোগ হয়, Acid Survivors and Women Welfare Foundation র সঙ্গে। তারপর বিভিন্ন ওয়ার্কশপে এসে কাকলি বুঝতে পারেন, তিনি একা নন, এই লড়াইয়ে আছেন আরও অনেকে। তাঁর থেকেও অনেক খারাপ পরিস্থিতিতে। অবশেষে এই সংস্থাই তাঁর জীবনে আশার বার্তা নিয়ে এসেছে। বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সংস্থা চালিত একটি কেকের দোকানে কর্মরতা কাকলি। এতেই দারুণ খুশি তিনি। এভাবেই আগামী জীবনটা নতুন করে সাজাতে চান তিনি। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে চান বাঁচতে চান প্রাণভরে। আর চান শাস্তি... এই দুষ্কৃতীদের চরমতম শাস্তি।