কলকাতা: করোনা পরিস্থিতি, রাজ্যে কার্যত লকডাউন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস-একের পর এক ধাক্কায় বিপর্যস্ত বহু মানুষ। অনেকেই জীবিকা বা আয়ের উৎস হারিয়েছেন। অনেকের আবার বাড়ি ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন অসংখ্য মানুষ। তেমনই একটি সংগঠন ‘মিশন আমরা’। বিভিন্ন পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত ১০ জন মিলে এই সংগঠন গড়ে তুলে মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মানুষের সেবার কাজ শুরু করেন। শুরুতে নিজেরাই অর্থ জোগান দিচ্ছিলেন। পরে আরও অনেকে এই মহৎ উদ্যোগে সামিল হয়েছেন। একটি কর্পোরেট সংস্থাও এগিয়ে এসেছে। ফলে ‘মিশন আমরা’-র সেবার পরিধি বেড়েছে।


এই সংগঠনের সদস্যরা রোজ কলকাতার চারটি হাসপাতাল এসএসকেএম, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল ও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের বাইরে ১,০০০ প্যাকেট খাবার বিলি করছেন। দক্ষিণ কলকাতার তিন জায়গা থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে ‘মিশন আমরা’-র সদস্যরা বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে হাসপাতালগুলির বাইরে পৌঁছে যাচ্ছেন। এরপর শুরু হচ্ছে খাবার বিলি। করোনাবিধি মেনেই খাবার বিলি করা হচ্ছে। বেলা দেড়টার মধ্যেই খাবার বিলির কাজ শেষ করে ফেলা হচ্ছে। মূলত হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর পরিবারের লোকজন, অ্যাম্বুল্যান্স বা অন্য কোনও গাড়ির চালক, দুঃস্থ মানুষজন খাবার সংগ্রহ করছেন।


এই উদ্যোগের অন্যতম শরিক পেশায় স্থপতি ও ডিজাইনার ভাবনা মাদাপ্পা জানালেন, ‘গত বছর লকডাউনের সময় মানুষের সমস্যা দেখেছি। এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়েও বহু মানুষ প্রিয়জনদের হারিয়েছেন। কাজ হারিয়ে অনেকেই তীব্র সমস্যায়। রাজ্যে কার্যত লকডাউন জারি হওয়ার পর অনেকেরই খাবার কেনারও সাধ্য নেই। অসংখ্য মানুষের এই অবস্থা দেখে আমরা কিছু করব বলে ঠিক করি। সেই ভাবনা থেকেই ‘মিশন আমরা’-র কাজ শুরু। প্রথমে রোজ ৭৫০ প্যাকেট খাবার এবং মাসে একবার করে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করি আমরা। পরবর্তীকালে আরও অনেকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। একটি কর্পোরেট সংস্থাও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমাদের সুবিধা হয়েছে।’


পেশায় অ্যাডভাইজারি অ্যানালিস্ট অনুষ্কা শরাফ জানালেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে দৈনিক আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেশি। অসংখ্য মানুষ সমস্যায় পড়েছেন। তারপর রাজ্যে কঠোর বিধিনিষেধ জারি হওয়ায় বাজার-দোকান খোলার সময় নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কলকাতার ফুটপাতে যাঁরা থাকেন বা যাঁদের দিন আনি দিন খাই অবস্থা, তাঁদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে। অনেকে আবার হাতে টাকা থাকলেও, দোকান-বাজার বন্ধ থাকায় খাবার কিনতে পারছেন না। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ। যত বেশি সম্ভব মানুষকে খাবার দিয়ে সাহায্য করতে চাইছি আমরা। আরও অনেক মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের লক্ষ্য।’


পেশায় সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট কনসালট্যান্ট বেদিকা গুপ্ত জানালেন, ‘আমরা মানুষের কাছে যেমন রান্না করা খাবার পৌঁছে দিচ্ছি, তেমনই শুকনো খাবারও দিচ্ছি। কলকাতার চারটি সরকারি হাসপাতালের বাইরে রোজ রান্না করা খাবার বিলি করছি আমরা। এর পাশাপাশি দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী ও বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে রেশন পৌঁছে দিচ্ছি। এক-একটি রেশন কিটে চারজন মানুষের খাবার থাকছে। আমরা এখনও পর্যন্ত ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের কাছে রেশন কিট পৌঁছে দিতে পেরেছি। শুরুতে রোজ ৭৫০ জনের হাতে রান্না করা খাবারের প্যাকেট তুলে দিচ্ছিলাম। এখন রোজ ১,০০০ প্যাকেট খাবার বিলি করতে পারছি।’


‘মিশন আমরা’-র অপর এক সদস্য পেশায় আইনি পরামর্শদাতা প্রার্থনা বাথিজা জানালেন, ‘আমরা যেমন রোজ রান্না করা নিরামিষ খাবারের প্যাকেট বিলি করছি, তেমনই সমস্যাগ্রস্ত মানুষের হাতে ফল, বিস্কুট, মুড়ি, ডাল, তেল তুলে দিচ্ছি। বাঁকুড়ায় এখনও পর্যন্ত ৭৩০ প্যাকেট রেশন পৌঁছে দিয়েছি। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর বাসন্তীতে ৩০০ প্যাকেট রেশন কিট দিয়েছি। মূলত দিনমজুর, ফুটপাতবাসী বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকেই আমরা খাবার দিয়ে সাহায্য করছি।’ 


‘মিশন আমরা’-র সদস্যরা এই উদ্যোগে অনেকের সাহায্য পাওয়ায় এবার আরও বেশি মানুষকে সাহায্য করতে চাইছেন। করোনার বিরুদ্ধে যাঁরা সামনের সারিতে দাঁড়িতে লড়াই করেছেন সেরকম লোকজন, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবার, দিনমজুরদের সাহায্য করাই এই সংগঠনের লক্ষ্য। করোনা আবহে খাবার বিলির কাজ কতদিন চলবে, সেটা এখনও ঠিক হয়নি। তবে আগামী কয়েকমাসের লক্ষ্য স্থির করা হয়ে গিয়েছে ভাবনা, অনুষ্কাদের। তাঁরা জানিয়েছেন, জুন, জুলাই, অগাস্টের মধ্যে প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষের হাতে খাবার তুলে দিতে চান। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে চাল, মুসুর ডাল, তেল, সয়াবিন, নুন, মুড়ি, বিস্কুট দিয়ে সাহায্য করাও তাঁদের লক্ষ্য। এরই সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে সাবান, মাস্ক, মহিলাদের প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী দিয়েও সাহায্য করছে এই সংগঠন।