নয়াদিল্লি: প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের প্রয়াণে শোকের ছায়া গোটা দেশে। পড়শি দেশ পাকিস্তানের একটি গ্রামেও শোকের আবহ এই মুহূর্তে। মনমোহনের প্রয়াণে মসজিদে বিশেষ নমাজের আয়োজন হল সেখানে। বাসিন্দারা মনমোহনের প্রয়াণে পরিবারের কেউ চলে গেলেন বলে মনে হচ্ছে গ্রামবাসীদের। মনমোহনকে কী নামে ডাকতেন তাঁরা, তা-ও খোলসা করলেন। (Manmohan Singh Demise)
ইসলামাবাদের ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম গাহ্। মনমোহনের প্রয়াণে শুক্রবার স্থানীয় মসজিদে বিশেষ নমাজের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গ্রামের শিক্ষক আলতাফ হুসেন বলেন, "গোটা গ্রাম শোকস্তব্ধ। মনে হচ্ছে আমাদের পরিবারের কেউ যেন চলে গিয়েছেন।" 'মোহনা'র মৃত্যুতে মন ভারাক্রান্ত বলে জানালেন তাঁরা। মনমোহনকে ওই নামেই ডাকতেন সকলে। (Pakistan Mourns Manmohan Singh Death)
বৃহস্পতিবার দিল্লির AIIMS-এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মনমোহন। ৯২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। শনিবার দিল্লিতে তাঁর অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হল। মনমোহনের শেষযাত্রায় চোখ রেখেছেন পাকিস্তানের ওই গ্রামের মানুষজনও। কারণ ওই গ্রামেই জন্ম মনমোহনের। দেশভাগের ক্ষত বুকে নিয়ে সেখানকার ভিটেমাটি ছেড়েই ভারতে চলে আসেন। পরবর্তীতে ভারতের ১৪তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
ছবি: PTI.
কিন্তু সীমানার বেড়াজাল, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন, কোনও কিছুই মনমোহনের সঙ্গে ওই গ্রামের নাড়ির সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেনি। মনমোহনের বাবা গুরুমুখ সিংহ কোহলি এক ফলব্যবসায়ীর অধীনে কাজ করতেন। মা অমৃত কউর মারা যান মনমোহনের যখন পাঁচ বছর বয়স। ঠাকুমা যমুনাদেবীর কাছেই মানুষ মনমোহন। গাহ্-র প্রাথমিক স্কুলেই পড়াশোনা। সেই স্কুলে আজও সংরক্ষিত রয়েছে মনমোহনের ভর্তির দস্তাবেজ। ১৯৩৭ সালের ১৭ এপ্রিল স্কুলে ভর্তি হন মনমোহন। ১৮৭ নম্বর পড়ুয়া ছিলেন তিনি। জাতির জায়গায় লেখা রয়েছে কোহলি।
ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন গোলাম মোস্তাফা। আগেও সংবাদমাধ্যমে মুখ খোলেন মোস্তাফা। জানান, পড়ুয়াদের আজও মনমোহনের রেকর্ড দেখান তাঁরা। তাঁরাও চাইলে মনমোহনের মতো হতে পারেন বলে উৎসাহ জোগান পড়ুয়াদের। প্রথম বার মনমোহন যখন প্রধানমন্ত্রী হন স্কুলের তাঁর সহপাঠীরা সেইসময় বেঁচে ছিলেন। বর্তমানে তাঁদের অনেকেই নেই। কিন্তু তাঁদের পরিবারের লোকজনের মুখে আজও মনমোহনের গল্প ফেরে।
স্কুলে মনমোহনের প্রিয় বন্ধু ছিলেন মহম্মদ আশরফ। তাঁর ছেলে মহম্মদ জামান জানিয়েছেন, মনমোহন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শুনে তাঁর বাবা পাগলপারা হয়ে যান। ছুটে এসে তাঁকে বলেন, "ওয়ে, আপনা মোহনা হিন্দুস্তান দা ওয়াজির হো গয়া (আমাদের মোহনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে)।" জামান জানিয়েছেন, সেই রাতে গোটা গ্রামে উৎসব হয়। যাঁরা কখনও মনমোহনকে দেখেননি, তাঁরাও গর্বে ফুলে ওঠেন। রূপকথার চরিত্র হয়ে ওঠেন মনমোহন। আশরফ বলেন, "বাবা বলত, মনমোহন মোমবাতির আলোয় পড়াশোনা করতেন। বাবা মাঠে খেলে বেড়াত। মনমোহন প্রস্তুতি নিতেন পরীক্ষার জন্য।"
১০ বছর বয়স পর্যন্ত ওই স্কুলে ছিলেন মনমোহন। পরবর্তীতে পেশোয়ারে বাবার কাছে চলে যান। সেখানে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ বলে অমৃতসর চলে আসেন তাঁরা। নতুন জীবন শুরু করেন। আশরফ পাকিস্তানেই থেকে যান। কিন্তু বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি। আশরফ জানিয়েছেন, "মাটি ভাগ হয়ে গিয়েছিল। আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন মানুষজন। কিন্তু 'আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে বেড়া তোলা যায়নি'।" ২০১০ সালে মারা যান আশরফ।
মনমোহনের মনেও একই ভাবে নিজের গ্রামের প্রতি টান ছিল। পাকিস্তানের এক সাংবাদিক রাজা আশিক আলি জানিয়েছেন, ২০০৪ সালে নিজের প্রধান সচিবকে দিয়ে তাঁর কাছে বার্তা পাঠান মনমোহন। গ্রামের উন্নয়নের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে বলে জানান। আর আশ্চর্যজনক ভাবে, তার পর থেকেই গ্রামের খোলনলচে বদলাতে শুরু করে। গ্রামের স্কুলটির উন্নয়নে, হাসপাতাল তৈরিতে, সৌরশক্তির জোগানে মনমোহন আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থাও করে দেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ভারতের এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট ওই উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত হয়। ৫১টি সৌরশক্তিচালিত আলো প্রযুক্তি বসে গৃহস্থদের জন্য। রাস্তায় সৌর আলোর স্তম্ভ বসে ১৬টি। তিনটি মসজিদে সোলার হিটারও বসানো হয়।
দিল্লিতে স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ। ছবি: PMO আর্কাইভ। (https://archivepmo.nic.in/drmanmohansingh/photogallery_next.php?pageid=1285)
২০০৮ সালে স্কুলের সহপাঠী রাজা মহম্মদ আলিকে ব্যক্তিগত ভাবে দিল্লি আসার আমন্ত্রণও জানান মনমোহন। সেই সাক্ষাতের মুহূর্তও মনের মণিকোঠায় বাঁধিয়ে রেখেছেন অনেকে। আশরফ জানিয়েছেন, মনমোহনের জন্য রাজা শাল এবং জুতো নিয়ে যান। আশরফের পরিবার পেশোয়ারের বিখ্যাত রেবাড়ী মিষ্টি পাঠায়। কিন্তু ২৬/১১ মুম্বই হামলার পর সব পাল্টে যায় বলে জানিয়েছেন আশরফ। বেঁচে থাকতে থাকতে আর কখনও গাহ্ যেতে পারেননি মনমোহন। তাঁর প্রয়াণের খবর বড্ড ভারী ঠেকছে গ্রামের মানুষদের। তাঁদের আক্ষেপ, মনমোহনের শেষকৃত্যেও শামিল হতে পারলেন না তাঁরা। অন্তত তাঁর স্ত্রী, কন্যারা যাতে একবার ঘুরে যান, আশাবাদী তাঁরা।
মনমোহনের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন বিদেশ মন্ত্রী খুশিদ মাহমুদ কসুরি। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে তিনি জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন মনমোহন। SAARC দেশগুলিকে একছাতার নীচে আনার কৃতিত্বও মনমোহনকেই দিয়েছেন তিনি। মনমোহনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খুরশিদ বলেন, "অমৃতসরে প্রাতরাশ, লাহৌরে মধ্যাহ্ণভোজ এবং কাবুলে নৈশভোজ সারা সম্ভব এমন দিন দেখতে চেয়েছিলেন মনমোহন।" জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে মীমাংসায় আসার প্রক্রিয়া যদি অটলবিহারি বাজপেয়ী শুরু করে থাকেন, সেই লক্ষ্যপূরণে মনমোহন নিজের মনপ্রাণ ঢেলে দেন বলে জানিয়েছেন খুরশিদ। তিনা জানান, নিজের গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছেও ছিল মনমোহনের।