আশাবুল হোসেন, দীপক ঘোষ ও অর্ণব মুখোপাধ্যায়: নেতা-মন্ত্রীরা ইতিমধ্যেই ব্যাটিং শুরু করে দিয়েছেন। দেশের নাম শুধু ভারত রাখার দাবি তুলছেন সকলে মিলে। বিরোধী জোটের I.N.D.I.A যাতে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা না পায়, তার জন্যই এমন অবস্থান কিনা, প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। সেই আবহে আরও একটি প্রশ্ন উঠছে, RSS-এর অ্য়াজেন্ডা-ই কি বাস্তবায়িত করছে বিজেপি? কারণ এ যাবৎ RSS-এর তরফে দেশের নাম শুধু ভারত করার দাবি উঠেছে একাধিক বার। (India or Bharat)
চলতি মাসের শুরুতেই RSS প্রধান মোহন ভাগবত দেশের নাম শুধু ভারত করার দাবি তোলেন। তিনি বলেন, "আমরা সকলের উচিত India শব্দটির ব্যবহার বন্ধ করা। তার পরিবর্তে ভারত শব্দটি ব্যবহার করা উচিত।" গত শুক্রবার অসমের গুয়াহাটিতে এই দাবি তুলেছিলেন সঙ্ঘপ্রধান ভাগবত। তার পর সোমবার থেকে সেই দাবি শোনা যেতে শুরু করল বিজেপি নেতাদের গলাতেও। (India Name Change)
বিজেপি-র জাতীয় সাধারণ সম্পাদক দুষ্মন্তকুমার গৌতমের বক্তব্য, "যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁদের বোঝা উচিত যে, তাঁদের সময়ই সর্বোচ্চ সম্মানের নামকরণ হয় 'ভারতরত্ন'। তাতেও ভারত রয়েছে। India রত্ন নয়, 'ভারতরত্ন' নাম হয়েছে। তাহলে দেশ তো ভারতই!"
কিন্তু হঠাৎ করে এই ইন্ডিয়া বনাম ভারত বিতর্ক কেন? কী কারণে? গত সাত দশক ধরে এই দেশকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন যে রাষ্ট্রনেতারা, সেই দেশের নাম ঘিরে হঠাৎ কেন এই বিতর্ক? জওহরলাল নেহরু থেকে অটলবিহারি বাজপেয়ী, পেরিয়ার থেকে রবীন্দ্রনাথ, যাঁদের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে এই ভারত, এই India, যার জোড়া নামের খ্য়াতি গোটা বিশ্ব জুড়ে, সেখানে একটি নামকে সুয়োরানি করে, অপরটিকে দুয়োরানি করার নেপথ্য়ের আসল কারণটা কী?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই RSS সংযোগ উঠে আসছে। দেশের নাম India নয়, শুধুমাত্র ভারত হওয়া উচিত, এই দাবি RSS-এর। মোহন ভাগবতের সাফ বক্তব্য, "কখনও কখনও ইংরেজি জানা কারও সামনে বলতে গেলে মুখে India চলে আসে। আমাদের উচিত, বলা এবং লেখার সময় ভারত নামটি ব্যবহার করা। সামনের জনের প্রয়োজন থাকলে, তিনি বুঝে নেবেন।"
বিজেপি-র অভিভাবক সংস্থা RSS. তাদের অ্যাজেন্ডার বাস্তবায়ন ঘটাতেই দেশের নামে হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। যদিও বিজেপি-তে থেকেও ভিন্ন অবস্থান ছিল বাজপেয়ীর। তাঁর বক্তব্য ছিল, "ক্ষমতার খেলা চলবে। সরকার আসবে যাবে। দল তৈরি হবে, নষ্ট হবে। কিন্তু এই দেশ থাকবে, দেশের গণতন্ত্রকে অমর করে রাখতে হবে।" বর্তমান বিজেপি নেতারা বাজপেয়ীর সেই নীতির ধার ধারছেন না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুমন্ত্র বসুর কথায়, "দু'দিন আগে ভাগবত বলেছিলেন। মোদি-শাহ এবং শীর্ষ নেতারা RSS-এর অনুসারী। RSS-এর কথা অনুযায়ীই হচ্ছে। গোটা বিশ্বের কাছে এটা হাস্যকর। ভারতের অনেক নাম। যে প্রেক্ষাপটে একটি মাত্র নাম রাখার কথা বলা হচ্ছে RSS-এর নিয়ম মেনে।" শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারও এ ব্যাপারে একমত। তাঁর বক্তব্য, "ওরা ওঁকে (ভাগবত) গুরু বলে মানেন। গুরু যা বলছেন, তাই করছেন।"
তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেনের গলাতেও একই সুর ধরা পড়েছে। তিনি বলেন, "RSS প্রধান মোহন ভাগবত বললেন, দেশের নাম ভারত করা উচিত। তাহলে আমরা ধরে নেব যে, মোদি-শাহ প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেড। তাঁরা RSS-এর অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত করতেই এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। "
প্রাচীনকাল থেকে নানা সময়, ভারতের নানা নাম উঠে এসেছে, জম্বুদ্বীপ, ভারতখণ্ড, হিমবর্ষ, অজ্ঞানবর্ষ, আর্যাবর্ত, হিন্দ, হিন্দুস্তান- তালিকা দীর্ঘ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিআর আম্বেদকরের নেতৃত্বে গঠিত হয় কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি, যার কাজ ছিল সংবিধানের খসড়া তৈরি করা।
দেশের নাম এবং ক্ষেত্র সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হলে, নামকরণ নিয়ে অ্যাসেম্বলির সদস্যদের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়।
সেই সময় ফরোয়ার্ড ব্লকের সদস্য হরি বিষ্ণু কামাত পরামর্শ দেন যে, প্রথম অনুচ্ছেদে ‘Bharat, or in the English language, India, shall be and such’ বলা হোক। আবার মধ্যপ্রদেশ এবং বেরারের প্রতিনিধি শেঠ গোবিন্দ দাসের প্রস্তাব ছিল: “Bharat known as India also in foreign countries”। ওদিকে ইউনাইটেড প্রভিন্সেসের পাহাড়ি অঞ্চলের প্রতিনিধি হরগোবিন্দ পন্থ স্পষ্ট করে দেন যে উত্তর ভারতের মানুষ ‘ভারতবর্ষ ছাড়া আর কিছুই চান না’। পরে ‘ইন্ডিয়া, অর্থাৎ ভারত, বিভিন্ন রাজ্যের সমষ্টি’, এই লাইনটিই গৃহীত হয়। সেই নাম নিয়েই আজ বিতর্ক।