চেন্নাই: প্রয়াত হলেন জয়ললিতা। সেই সঙ্গে তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে একটি যুগের অবসান হল। শুধু তামিলনাড়ুরই বা কেন, ভারতীয় রাজনীতির এক অন্যতম বর্ণময় চরিত্রের জীবনাবসান হল।

১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণাটকের মহীশূরের ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয় জয়ললিতার। একদা টিনসেল টাউনের জনপ্রিয় অভিনেত্রী বিগত তিন দশক ধরে তামিলনাড়ুর রাজনীতির অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিভিন্ন সময় দুর্নীতির অভিযোগ তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু অনবদ্য দক্ষতা, সঙ্কল্প ও সংগ্রামের জোরে তিনি স্বমহিমায় বারেবারেই ফিরে এসেছিলেন।

ষাট ও সত্তরের দশকে বহু তামিল ছবির বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে অভিনয় করেন তিনি। তাঁর মেন্টর তথা সুপারস্টার এমজিআর-এর সঙ্গে জুটি বেঁধে ২৮টি ছবি করেন জয়ললিতা। পরবর্তীকালে এআইএডিএমকে-তে যোগ দিয়ে এমজিআর-এর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সাফল্যের সঙ্গে বহন করেন তিনি।

১৯৮২ সাল থেকে রাজনীতিতে যোগ দেন জয়ললিতা। এর পরের বছরেই এমজিআর-এর প্রচার সচিব হন জয়া। ১৯৮৪ সালে রাজ্যসভার সদস্য হন তিনি। ১৯৮৭ সালে এমজিআর-এর মৃত্যুর পর দল পরিচলনার ক্ষেত্রে অনবদ্য রাজনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দেন জয়ললিতা। পাঁচবার তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। দুর্নীতির অভিযোগ দু-দুবার তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু দুবারই নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটান তিনি।

জন্মসূত্রে তামিল না হয়েও, তিনি ছিলেন এআইএডিএমকে সমর্থকদের প্রাণের ‘আম্মা’। শেষপর্যন্ত প্রিয় আম্মা-হারা হল তামিলনাড়ু। তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে ‘পুরুতচি থালাইভি’ বা ‘বিপ্লবী অগ্নিকন্যা’ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। অনুগামীরা ডাকতেন ‘আম্মা’ বলে।

এমজিআরের মৃত্যু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম সন্ধিক্ষণ। রাজাজি হলে যেখানে এমজিআর-এর মরদেহ রাখা ছিল, সেই বেদি থেকে তাঁকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেওযার চেষ্টা করেছিলেন দলের এক নেতা। এই সময় থেকেই এআইএডিএমকে-র রাশ নিজের হাতে নিতে দীর্ঘ লড়াই শুরু করতে হয় তাঁকে। জয়ললিতার বিরুদ্ধ শিবিরে ছিলেন এমজিআর মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য আর এম বীরাপ্পনের মতো নেতা। শেষপর্যন্ত  পর ভাঙন ধরে এআইএডিএমকে দলে। দুটি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। একটা গোষ্ঠী পরিচিত ছিল জয়ললিতার নামে-এআইএডিএমকে (জেএ)। অন্যটি এমজিআরের স্ত্রীর নামে। শেষপর্যন্ত এমজিআরের দলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতেই তুলে নিতে সক্ষম হন জয়ললিতা।

১৯৮৯ সালে বিধানসভার ভোটে জিতে হন তামিলনাড়ুর বিরোধী দলনেত্রী।রাজ্য বিধানসভার প্রথম মহিলা বিরোধী দলনেত্রী।

এরপর ১৯৯১ সালে একেবারে মসনদে। সেবার ভোটের আগেই কংগ্রেসের হাত ধরেছিলেন জয়ললিতা। আর সেবারই ভোটের প্রচারে তামিলনাড়ুতে গিয়ে রাজীব গাঁধীর মৃত্যু। যে ঘটনার এআইএডিএমকের পালে লেগেছিল সহানুভূতির হাওয়া।

প্রতিপক্ষ ডিএমকে-কে হারিয়ে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন এআইএডিএমকে’র জয়ললিতা।

পাঁচ বছর পর আর ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি।

১৯৯৬ সালের বিধানসভা ভোটেই হার।

আবার ২০০১ সালে মসনদে।

বার বার ফিরে আসা। আর বার বার বিতর্ক। কখনও পালিত পুত্র সুধাকরণের বিয়েতে এলাহি আয়োজন, সবার চোখ কপালে তুলেছে..কখনও বিতর্ক হয়েছে, তাঁর বাড়ি-গাড়ি-জুতো-শাড়ি নিয়ে। জয়ললিতা মানেই যেন পাহাড় প্রমাণ বৈভব...হাজারো অভিযোগ...চোখ ধাঁধানো ক্যারিশ্মা...এই ভাবমূর্তি নিয়েই পোয়েজ গার্ডেনের বাসিন্দা বার বার ফিরে এসেছেন ক্ষমতার অলিন্দে।

২০১১ সালে আবারও মুখ্যমন্ত্রী হয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, এভাবেও ফিরে আসা যায়।

কিন্তু, তিন বছর যেতে না যেতেই তুমুল ধাক্কা। ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন মামলায় চার বছরের কারাদণ্ড হয় জয়ললিতার। সঙ্গে ১০০ কোটি টাকার জরিমানা। খোয়াতে হয় মুখ্যমন্ত্রিত্বও।

পরের মাসে, সুপ্রিম কোর্ট থেকে অন্তর্বর্তী জামিন পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পান আম্মা।

সুখবরটা আসে ২০১৫’র ১১ মে। জয়ললিতাকে বেকসুর খালাস করে দেয় কর্ণাটক হাইকোর্ট।

এরপর, ২০১৬ সালে ফের জয়। ফের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই থেকে গেলেন শেষ দিন পর্যন্ত।