রায়পুর, ভোপাল ও বাঁকুড়া: ভোপালে আকাঙ্খা খুনের আগে ২০১০ সালে একই দিনে বাবা-মাকে খুন। উদয়নের বয়ানের ভিত্তিতে রায়পুরের বাড়িতে খোঁড়াখুঁড়ি। মিলল পুরুষ-মহিলার দেহাংশ, বালা, বেল্ট। খোঁড়াখুড়ির সময় আগাগোড়া নির্লিপ্ত ছিল উদয়ন।
প্রেমিকা আকাঙ্খা শর্মাকে খুনের কথা স্বীকার করার পরেই ধৃত উদয়ন দাস জানিয়েছিল, আরও হাড় হিম করা তথ্য! নিজের মুখে মা-বাবাকে খুনের কথা কবুল করেছিল সে!


দেহের খোঁজ পেতে শনিবার রাতেই তাকে ছত্তীসগড়ে রায়পুরে নিয়ে যায় বাঁকুড়া ও ভোপাল পুলিশের যৌথ দল। সকালে নিয়ে যাওয়া হয় সুন্দরনগরের বাড়িতে। ফের শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। উদয়ন নিজেই পুলিশকে দেখিয়ে দেয়, বাড়ির এই বাগানেই সে মা-বাবাকে খুন করে পুঁতে দিয়েছিল!


মাটি খোঁড়ার জন্য কয়েকজন শ্রমিককে আগে থেকেই তৈরি রেখেছিল রায়পুর পুলিশ। উপস্থিত ছিলেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরাও। উদয়নের দেখানো জায়গাতেই শুরু হয় মাটি কোপানোর কাজ! কিন্তু অনেকটা গর্ত খোঁড়া হয়ে গেলেও, কিছুই না মেলায় সন্দেহ তৈরি হয় পুলিশের মনে! যদিও হাল ছাড়েননি তদন্তকারীরা। ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় মাটি কাটার যন্ত্র।


তা দিয়ে মাটি কাটা শুরু হওয়া মাত্রই দুর্গন্ধে ছেয়ে যায় গোটা এলাকা। এরপরের ছবিটা কী হতে পারে বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারওর। কিছুক্ষণের মধ্যেই কঙ্কাল দেখতে পাওয়া যায় উদয়নের বাড়ির বাগানে!যন্ত্র থামিয়ে, ফের হাতে মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু হয়। একে একে বেরিয়ে আসে, দুটি খুলি, হাড়গোড়, প্যান্ট ও কাপড়ের টুকরো!


পুরুষ ও মহিলার দেহাংশগুলি দেখে পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, দু’জনকে বিপরীত দিকে শোয়ানো ছিল। দেহের ওপর বালি ফেলা হয়েছিল! এরপর রাখা হয়েছিল সিমেন্ট ভর্তি বস্তা! তারপর মাটি। পুলিশ সূত্রে দাবি, উদয়ন জেরায় জানিয়েছে, দেহ চাপা দিতে, বাড়ির বাগানে ৪ ট্রাক্টর মাটি ফেলেছিল সে!
উদয়নের দাবি, এগুলি তারই হাতে খুন হওয়া, তার মা-বাবার হাড়গোড়। যদিও বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে, দেহাংশের সঙ্গে উদয়নের ডিএনএ-র নমুনা মিলিয়ে দেখবে পুলিশ!


রায়পুর স্টেশন থেকে সুন্দরনগরের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। ছিমছাম শহর। বাসিন্দাদের বেশিরভাগই অভিজাত। অনেকটা সল্টলেকের মতো। এই বাড়িতেই দীর্ঘদিন কেটেছে উদয়নের! মা-বাবার সঙ্গে সেখানেই দু’জনকে খুন করে দেহ লোপাট! আপাত নিরীহ চেহারার উদয়নকে যত দেখছেন, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছেন দুঁদে গোয়েন্দারাও!



কিন্তু যাঁরা তাকে জন্ম দিয়েছিল, বড় করেছিল, সেই তাঁদেরই কেন খুন করল এই যুবক? পুলিশ সূত্রে দাবি, উদয়ন জেরায় দাবি করেছে, সে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করতে পারেনি। কিন্তু বাড়িতে সে, সেটা চেপে গিয়েছিল। যতদিন কোর্স চলেছে, ততদিন, উদয়নের মা-বাবা ছেলের ফেল করার বিষয়ে কিছুই জানতেন না! কলেজে যাওয়ার নাম করে নিয়মিত বাড়ি থেকে টাকা নিত সে!


কিন্তু কোর্স শেষ হতেই, আর পাঁচটা বেকার ছেলের মতো, বাড়িতে চাকরি নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় উদয়নকে। তার উচ্ছৃখল জীবনযাপন নিয়েও মা-বাবার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই বচসা হত। পুলিশের দাবি, উদয়ন জানিয়েছে, বাড়ির এই চাপ সামলানোর জন্যই, মা-বাবাকে খুনের ছক কষে উদয়ন!


উদয়নকে জেরা করে পুলিশ জানতে পেরেছে, ২০১০ সালে, একদিন তার মা বাড়িতে একা ছিলেন। সেইসময় মায়ের গলা টিপে খুন করে উদয়ন। বাবা সেইসময় বাইরে ছিলেন। বাড়ি ফিরে তিনি উদয়নের কাছে স্ত্রীর কোথায় জানতে চান। খুনের কথা চেপে গিয়ে, ছেলে বলে, মা বাইরে গিয়েছে। এরপরই বাবার জন্য চা বানায় উদয়ন। কিন্তু সেই চায়ে মিশিয়ে দেয় কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ। ওই চা খাওয়ামাত্রই বেহুঁশ হয়ে পড়েন বাবা। এতে ছেলের কাজ আরও সহজ হয়ে যায়। উদয়নের দাবি, এরপরই সে নিস্তেজ বাবাকে গলা টিপে মারে!


মা ও বাবার দেহ, বাড়ির এই বাগানেই পুঁতে দেয়ে সে! এরপর রায়পুরের সুন্দরনগরের বাড়ি বিক্রির পরিকল্পনা করে উদয়ন। থ্রিলারের এখানেই শেষ নয়! পুলিশ সূত্রে দাবি, খুনের পর, জাল লাইফ সার্টিফিকেট তৈরি করে, মায়ের পেনশনও তুলেছিল এই গুণধর ছেলে! কিন্তু প্রায় এক বছর এরকম চলার পর, আপত্তি তোলেন সরকারি আধিকারিকরা। বলেন, মাকে হাজির করাতে হবে। এরপরই প্ল্যান বদলে ফেলে উদয়ন। মধ্যপ্রদেশ থেকে মায়ের ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করে পেশ করে সে।


এরপর একজনকে পাওয়ার অফ অ্যার্টনি দিয়ে, পাকাপাকিভাবে ভোপালের সাকেতনগরে বসবাস করতে শুরু করে উদয়ন! উদয়নের মা-বাবার দেহাংশ উদ্ধারের পর, আকাঙ্খার বাবা মনে করছেন, তাঁদেরও ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়েই বাঁকুড়া গিয়েছিল সে! তিনি বলেন, আমাদেরও খুন করতে পারত। আমাদেরও শেষ করে দিতে পারত।


লিভ ইন চলাকালীন অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক, নেশা করা নিয়ে আপত্তি--প্রেমিকাকে খুনের পিছনে এরকম নানা তত্ত্ব খাড়া করেছে উদয়ন। যদিও পুলিশ এগুলিকে এখনই মান্যতা দিতে নারাজ!


কারণ, ২০১৬ সালের জুন মাসে ভোপালে গিয়েছিল আকাঙ্খা। আর জুলাই-অগাস্ট নাগাদই তাঁকে খুন করা হয়! অর্থাত পরিকল্পনা হয়েছিল তারও আগে। তদন্তকারীদের প্রশ্ন, তাহলে কি কোনওভাবে আকাঙ্কা জেনে গিয়েছিল, যে উদয়নের মা-বাবা আগেই খুন হয়েছেন? খুন করেছে উদয়নই! আর সে কারণেই কি শেষ হয়ে গেল ‘আকাঙ্খার আকাঙ্খা’? একসঙ্গে উত্তর খুঁজছে তিন রাজ্যের পুলিশ।