কোনও গল্পগাথা নয় ভারতীয় নৌসেনার এক মার্কোস কম্যান্ডোর জীবনমৃত্যু লড়াইয়ের রোমহর্ষক কাহিনী যা যে কোনও উপন্যাসকে হার খাইয়ে দেবে যা কোনও সিনেমার স্ক্রিপ্টের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়


নাম ক্যাপ্টেন বরুণ সিংহ। বাবা নৌসেনার অফিসার ছিলেন। বরুণও বাপ কা বেটা! জানান, জন্মকালে জানা যায়, তাঁর কুণ্ডলীতে না কি লেখা ছিল তিনি জলে মারা যাবেন। এই শুনে তাঁর বাবা বলেছিলেন, তাহলে ভাগ্যের সঙ্গে সম্মুখসমরে যেতে হবে ওকে। এই বলে বাবা ছেলের নামকরণ করেন বরুণ (পৌরাণিক মতে জলের দেবতা)। ছোটবেলায় শাহরুখ খান অভিনীত ‘ফৌজি’ সিরিয়াল দেখতে ভাসবাসতেন। পড়া শেষ করে নৌসেনায় ভর্তি হন বরুণ।


কিন্তু, বরুণের জীবন পাল্টে যায় ঠিক ১৬ বছর আগে। সালটা ২০০০। নৌসেনার মেরিন কম্যান্ডোস (মার্কোস)-এর একটি টিমের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের উলার হৃদে পোস্টিং পেয়েছিলেন বরুণ। সেই সময় তিনি জুনিয়র অফিসার ছিলেন।


মার্কোস হল ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ক্ষিপ্র কম্যান্ডো বাহিনী। বিশ্বের প্রথম সারির কম্যান্ডো বাহিনীর তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে মার্কোস। অন্য কম্যান্ডোদের থেকে দৃশ্যত আলাদা হয় মার্কোস-রা। ছদ্মবেশের সুবিধার জন্য এঁদের মুখ-ভর্তি দাড়ি থাকে। যে কারণে, জঙ্গিরা এঁদের দাড়িওয়ালা ফৌজি বলে ডাকে।


মেরিটাইম ওয়ারফেয়ার এবং অ্যাম্ফিবিয়াস অপারেশনস-এর জন্য বিখ্যাত বলেই মার্কোসকে উলার লেকে পাঠানো হয়েছিল। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, সেখান দিয়ে কোনও জঙ্গি অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করলে যে কোনও মূল্যে তাকে নিকেশ করা।


বরুণ জানান, তখন ছিল মে মাস। পাকিস্তান হয়ে জঙ্গিরা নতুন করে অনুপ্রবেশ করা শুরু করেছে। এর মধ্যেই দলের কাছে খবর আসে, বান্দিপোরার কাছে পুত্তুশাহি গ্রামের মধ্যে একটি বাড়িতে আত্মগোপন করে রয়েছে তিন আল-বদর জঙ্গি।



বরুণের পোস্টিং অন্যত্র ছিল। কিন্তু, জঙ্গিদমন অভিযানের সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না তিনি। টিমের সঙ্গে বান্দিপোরায় যোগ দিতে কম্যান্ডিং অফিসারের অনুমতি চান। তা মিলেও যায়।


কালবিলম্ব না করে, পুত্তুশাহিতে পৌঁছে যায় কম্যান্ডোরা। দেখেন, একটা বিশাল বাড়িতে লুকিয়ে রয়েছে জঙ্গিরা। বাড়িটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে বাহিনী। বরুণ এবং আরেক কম্যান্ডো পাশের বাড়ির ছাদে ওঠেন। তাঁরা বুঝতে পারেন, কোনওভাবে অনুপ্রবেশকারীদের ওই বাড়ি থেকে টেনে বের করতে হবে।


বরুণ ছিলেন দলের বিস্ফোরক-বিশেষজ্ঞ। বাড়ির মধ্যে সন্দেহজনক গতিবিধি নজরে আসতেই, তা লক্ষ্য করে দুটি তলায় গ্রেনেড ছোঁড়েন তিনি। কিন্তু কোনও লাভ না হওয়ায় কম্যান্ডিং অফিসারের নির্দেশে একটি আরডিএক্স ডিভাইস চটজলদি তৈরি করে দেন তিনি। আরডিএক্স বিস্ফোরণে জঙ্গিদের বাড়িটি পুরোপুরি ধসে যায়।


কম্যান্ডোরা দেখতে পান এক জঙ্গির দেহ বাড়ির পিছনে একটি দেওয়ালে রয়েছে। তবে, আরও ২ জঙ্গির কোনও খোঁজ মেলেনি তখনও। তল্লাশি অভিযান চালাতে পিছনের পাঁচফুট পাঁচিল টপকে বাড়ির চত্বরে প্রবেশ করেন কম্যান্ডোরা।


বরুণ জানান, তিনিও ঢোকেন। কিছুদূর এগোতেই তাঁদের দিকে এলোপাথারি গুলিবৃষ্টি শুরু করে জঙ্গিরা। প্রথমে তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না কোনদিক থেকে গুলি আসছে। পরে দেখেন, গোয়ালঘরে ঘাপটি মেরে রয়েছে ২ জঙ্গি।


এর মধ্যেই একটি খোলা জায়গায় আটকে পড়ে ২ জওয়ান। জঙ্গিরা তাঁদের লক্ষ্য করেই গুলি চালাচ্ছিল। সেই ফাঁকে অন্যদিক দিয়ে জঙ্গিদের দিকে এগিয়ে যান বরুণ। স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, জওয়ানরা আটকে পড়েছিল। না পারছিল এগোতে, না পিছোতে। আমি ওদের সামনে ছিলাম।


তিনি বলতে থাকেন, আচমকা দেখি, গুলি চালাতে চালাতে ২ জঙ্গি গোয়াল-ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি দ্রুত নিজেকে সরিয়ে অন্য দিক দিয়ে ওদের ঘিরে ফেলার কৌশল নিই। আমি জঙ্গিদের থেকে মাত্র পাঁচ মিটার দূরত্বে ছিলাম। তবুও, ওরা আমাকে দেখতে পায়নি। ওরা ওই ২ জওয়ানকেই শুধুমাত্র লক্ষ্য করেছিল।


একটা সুযোগ পেয়েই খুব কাছ থেকে জঙ্গিদের গুলি করেন বরুণ। ২ জনই পড়ে যায়। কিন্তু, তখনই ঘটে যায় এমন এক ঘটনা, যা কখনই কল্পনা করেননি বরুণ। মরার আগে এক জঙ্গি বরুণকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দেয়।


কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে এই মার্কোসের জীবন আমূল পাল্টে যায়। গুলি এসে লাগে বরুণের বুকের ডানদিকে। সেখানে লাগানো ছিল কয়েকটি হ্যান্ড-গ্রেনেড। গ্রেনেড বিস্ফোরণ না ঘটলেও, গুলিতে তার স্প্লিন্টার বরুণের সারা বুকে ছড়িয়ে পড়ে।


বরুণ জানান, তিনি ডান হাত তুলতে পারছিলেন না। প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় তাঁকে শ্রীনগরে সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিত্‍সকরা তাঁর অবস্থা দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না।



বুকের ডান দিক এবং ডান হাত মিলিয়ে প্রায় ৭৬টি স্প্লিন্টার্স ছড়িয়ে পড়েছিল বরুণের দেহে। তাঁর ডান হাতের হিউমেরাস (কাঁধ থেকে কব্জি পর্যন্ত হাড়) ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। ডানদিকের ফুসফুস একেবারে ছিঁড়ে গিয়েছিল। একটা শার্পনেল হৃদপিণ্ডে ঢুকে গিয়েছিল।


এক কথায় প্রায় মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন বরুণ। তবুও, চিকিত্‍সকরা হাল ছাড়েননি। জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হৃদপিণ্ড থেকে শার্পনেল বের করা হয়। পায়ের হাড় দিয়ে হাতের হাড় প্রতিস্থাপন করা হয়। কিন্তু, তাঁরা জানিয়ে দেন, শরীরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৭৫টি স্প্লিন্টার বের করা সম্ভব নয়।


জীবনের হাল ছাড়েননি বরুণও। হাসপাতালের বিছানায় প্রায় ২ বছর কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। এক বছর ডান হাত প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছিল। আজও, তাঁর সারা শরীরে স্প্লিন্টারগুলি রয়ে গিয়েছে। একটি ফুসফুস এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যে তাকে বাদ দিতে হয়। এখন একটি ফুসফুস দিয়ে শ্বাস নেন বরুণ।


এই যোদ্ধা জানান, এত ব্যথার মধ্যেও তিনি এক ফোঁটা চোখের জল ফলেননি। কিন্তু, হাসপাতালে নিজের তিন বছরের মেয়ের একটি কথায় নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি। বরুণ বলেন, ধারা তেলের বিজ্ঞাপনের গান গেয়ে আমার মেয়ে বলল, আমার বাবা স্ট্রংগেস্ট... তখন আমি কেঁদে ফেলেছিলাম!


অসীম সাহসিকতা, বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য ২০০১ সালে বরুণকে সৌর্য চক্র প্রদান করা হয়। তবে, শারীরিক কারণে মার্কোস-এর ফিল্ড ডিউটি থেকে তাঁকে সরে আসতে হয়। বরুণকে প্রথমে নৌসেনার জাহাজ ওপিভি (অফশোর প্যাট্রল ভেসেল) সারদা-র কম্যান্ডিং অফিসার করা হয়। তাঁর অবদানের কথা মাথায় রেখে বর্তমানে তাঁকে ‘আইএনএস কর্ণ’ -এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।


বিশাখাপত্তনমের কাছে অবস্থিত ‘আইএনএস কর্ণ’ হল মার্কোস কম্যান্ডোদের নতুন বেস। এখন যার মাথায় একজন প্রাক্তন-মার্কোস। এই পদের ডন্য বরুণ যে সত্যিই যোগ্য সেই বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।


(বরুণের মতো বীর সৈনিকের কথা অনেকেই জানেন না বা শোনেন নি একবার এই অসীমসাহসী অফিসারের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিলসেখানেই,  তাঁর মুখ থেকে শোনা সেই গল্প॥)