সুজাত বুখারি
জঙ্গি গোষ্ঠী হিজবুল মুজাহিদিন-এর কমান্ডার বু রহান ওয়ানির মৃত্যুর যে প্রতিক্রিয়া কাশ্মীরে দেখা গেল এবং যাচ্ছে, তা বোধহয় রাজ্যের দুই শাসক দল বিজেপি এবং পিডিপি আশা করেনি। ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা সহ অনেকেই বলেছেন, জীবিত বুরহানের থেকে মৃত বুরহান অনেক বেশি বিপজ্জনক। কথাটা সত্য প্রমাণিত হচ্ছে।
ছাব্বিশ বছর আগে ভারতীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে সংঘাতের সূচনা, তাতে এই প্রথম দেখা গেল, একটি জঙ্গি বাহিনীর নায়কের মৃত্যুর বিরুদ্ধে সংঘটিত জনবিক্ষোভ দমনের ফলে এত মানুষ মারা যাচ্ছেন। ২০০৮ সালে সংঘাত শুরু হয়েছিল জমি নিয়ে— তৎকালীন রাজ্যপাল শ্রী অমরনাথ শ্রাইন বোর্ডকে বিরাট একটা বনভূমি পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। কাশ্মীরের মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে নানা ভাবে যথার্থ রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে এসেছেন, রাজ্যপালের এই সিদ্ধান্ত তাঁদের আরও সন্ত্রস্ত করে তোলে। এর ফলে কেবল রক্তক্ষয় ঘটেছিল তা-ই নয়, জম্মু ও কাশ্মীরের সাম্প্রদায়িক বিভাজনও এর পরে তীব্রতর হয়। সে বছর ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনে ভোটদানের হার আগের সব রেকর্ড ভেঙে দেয় এবং তার মধ্যে কাশ্মীরের বাস্তবের অন্য এক মাত্রা উন্মোচিত হয়, কিন্তু সমাজের একটা বিরাট অংশের ভারত-বিরোধী মনোভাব প্রবল ছিলই।
এর দু’বছর পরে এক সাজানো সংঘর্ষে সেনাবাহিনীর গুলিতে তিন জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু এবং এক তরুণ ছাত্রের নিহত হওয়ার ঘটনায় জনরোষ ফেটে পড়েছিল। তখন মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ওমর আবদুল্লা। জনবিক্ষোভ দ্রুত ভারতবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয় এবং ১৩০ জনের মৃত্যু হয়। আগুন নিভতে অনেকটা সময় লেগেছিল। সমাজের অসন্তোষ যায়নি। ওমর আরও চার বছর গদিতে থাকেন, কিন্তু তাঁর শক্তি হারিয়ে যায়।
২০১৪ সালে রাজ্যের নির্বাচনে ফলাফলে কোনও দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তার ওপর এক দিকে জম্মু এবং অন্য দিকে কাশ্মীর উপত্যকায় ভোটের ফল সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যায়। পরিণামে বিজেপি এবং পিডিপির জোট ক্ষমতায় আসে, যে জোটকে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদ বলেছিলেন ‘উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর মিলন’। মুসলমান এবং কাশ্মীরের বিরোধী বলে পরিচিত বিজেপির সঙ্গে পিডিপির এই হাত মেলানোর সিদ্ধান্ত কাশ্মীরের মানুষের হতাশা আরও বাড়িয়ে তোলে।
সমাজে এই গভীর হতাশার পরিবেশে পিডিপি-বিজেপি জোট ক্ষমতায় আসে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আফজল গুরুর ফাঁসি হয়। এই ঘটনায় কাশ্মীরের মানুষ, বিশেষত সেখানকার তরুণ সমাজ নতুন করে উপলব্ধি করেন যে, দিল্লির কর্তারা তাঁদের কথা কিছুমাত্র না ভেবে যা খুশি করতে পারেন। ২০০১ সালে সংসদে জঙ্গি হামলায় অভিযুক্ত আফজলের নাম ফাঁসির আসামিদের তালিকায় সবচেয়ে নীচে ছিল, কিন্তু কংগ্রেস তাঁকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ তারা ভেবেছিল এতে বিপুল ‘জাতীয়তাবাদী’ জনসমর্থন পাওয়া যাবে ও তার জোরে মোদীকে ঠেকানো যাবে। সে আশা অবশ্য পূর্ণ হয়নি।
ইতিমধ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অসহিষ্ণুতার মাত্রা বেড়ে চলে। সব মিলিয়ে কাশ্মীরের তরুণরা আরও বেশি করে নিরাপত্তাবোধের অভাবে ভুগতে থাকেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁদের আর্থিক সমস্যা, বেকারত্ব। হিংসার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হয়, রাজনৈতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের যে প্রক্রিয়া চলছিল, সেটা বানচাল হয়ে যায়।
এই প্রেক্ষিতেই দেখা যায়, নিহত জঙ্গিদের শেষযাত্রায় মানুষের যোগদান প্রবল ভাবে বেড়ে গিয়েছে। তাঁরা কেবল জঙ্গি আন্দোলনে যুক্ত স্থানীয় তরুণদের পক্ষ নিচ্ছেন না, বিদেশিদের সমর্থনেও সমবেত হচ্ছেন। এ বছরের গোড়ার দিকে লস্কর-এ-তইবা’র পাকিস্তানি কমান্ডার আবু কাসিম নিহত হলে, ত্রিশ হাজারের বেশি মানুষ অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দেন। সক্রিয় জঙ্গিয়ানার প্রতি কাশ্মীরের বিপুলসংখ্যক মানুষের এই সমর্থন সংকেত দেয় যে, কাশ্মীর আবার নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকের অবস্থায় ফিরে গিয়েছে, যখন বহু তরুণ হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিল এবং ঘরে ঘরে আশ্রয় পেয়েছিল।
যে কোনও সংঘাতের মতোই কাশ্মীরের সমস্যারও অনেকগুলো স্তর আছে। একটা স্তরে আছেন সেই সব মানুষ, যাঁরা কাজ করতে চান, নির্বাচনে যোগ দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার গড়তে চান। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গেই আছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক তীব্র ক্ষোভ। সেই ক্ষোভে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের জন্য রাজ্যবাসীর প্রবল আকাঙ্ক্ষার একটা প্রতিফলনও ঘটে। মানুষ সমাধান চান, সুস্থিতি চান।
২০০৩ থেকে ২০০৮— এই সময়পর্বে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তিপ্রক্রিয়া যখন বেশ এগোচ্ছিল, ভারত সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গেও আলোচনা চালাচ্ছিল, তখন কাশ্মীরের মানুষ সেই সব উদ্যোগে প্রবল সমর্থন জানিয়েছিলেন, তাঁদের আশা হয়েছিল যে একটা সমাধানের পথ বেরোবে। কিন্তু ২০০৮-এর ২৬ নভেম্বর মুম্বই সন্ত্রাস সেই প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করে দেয়। তার পর রাজনৈতিক সমাধানের সন্ধান বানচাল হয়ে গিয়েছে, বস্তুত কাশ্মীর বলে যে একটা ব্যাপার আছে সেটাই যেন অস্বীকার করা হচ্ছে। তার বদলে এসেছে নতুন সব ধারণা— সৈনিক কলোনি, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্য স্বতন্ত্র কলোনি এবং আরও নানা ব্যাপার, যেগুলি গড়পড়তা কাশ্মীরি মানুষের নিরাপত্তাবোধের অভাব বাড়িয়ে তোলে।
দীর্ঘ দিন ধরে ভিতরে ভিতরে জমতে থাকা এই ক্ষোভই বুরহান ওয়ানির হত্যাকাণ্ডের পরে ফেটে পড়েছে। বুরহানের শেষযাত্রায় প্রায় দু’লাখ মানুষের ভিড় হয়, যা অভূতপূর্ব ব্যাপার। জঙ্গি মোকাবিলায় সামনের সারিতে থাকার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক পুলিশ অফিসারের মতে, বুরহান নিজে কখনও কোনও সশস্ত্র আক্রমণে অংশ নেয়নি। এই অফিসার তাঁর ফেসবুক পেজ-এ লিখেছেন, ‘সত্য এই যে, ও (বুরহান) সোশাল মিডিয়ায় যত বীরত্বই দেখাক, যত বড় বীরের ভাবমূর্তিই থাকুক ওর, আসলে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ও একটা লড়াইও লড়তে পারেনি।’ তা হলে কাশ্মীরি প্রতিরোধের নতুন প্রতিমূর্তি হিসেবে বুরহান কী ভাবে অমরত্ব অর্জন করল?
বুরহান কাশ্মীরের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি, সে মানুষকে আকর্ষণ করতে সোশাল মিডিয়াকে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করেছে। নব্বইয়ের দশকের জঙ্গিদের সঙ্গে তার তফাত হল, সে কোনও মুখোশ ব্যবহার করেনি, কোনও ছদ্মনাম নেয়নি। একটা করে ভিডিয়ো পোস্ট করেছে এবং তা ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। পুলিশ অফিসাররা বলেন, বুরহান কিছু মানুষের কাছে প্রেরণাস্বরূপ হয়ে উঠেছিল, তবে তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে, সে কাশ্মীরের জঙ্গি আন্দোলনকে একটা নতুন চেহারা দিয়েছে, এবং তার দেশজ রূপটাকে ফিরিয়ে এনেছে। পাকিস্তান কাশ্মীরে হিংসার প্রধান পান্ডা হতে পারে, কিন্তু এক জঙ্গি নায়কের অন্ত্যেষ্টিতে যে ভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছে, যার পরিণামে ছত্রিশ জনের মৃত্যু হল, সেটা কাশ্মীরে একটা নতুন পরিস্থিতিকে চিনিয়ে দেয়।
কাশ্মীর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, তার অভাব, সমস্যার স্বরূপটিকে স্বীকার না করে তাকে কেবল পাকিস্তানের মদতে পুষ্ট জঙ্গিয়ানা হিসেবে দেখার প্রবণতা অথবা নিছক আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলে উড়িয়ে দেওয়ার রীতি, এবং গড়পড়তা কাশ্মীরি মানুষ যে অসন্তুষ্ট, অতৃপ্ত, ক্ষুব্ধ, এই সত্যটি অস্বীকার করে চলার ধারাই কাশ্মীরকে আজ আবার সেই পুরনো অন্ধকারে ফিরিয়ে দিয়েছে। কাশ্মীর একটি আগ্নেয়গিরি ছিল এবং আছে, যে কোনও সময়ে যার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।