নয়াদিল্লি:  একাধিক ব্যাঙ্ককর্মীর সঙ্গে মিলে হীরে ব্যবসায়ী নীরব মোদী কীভাবে পিএনবি সহ একাধিক ব্যাঙ্কের সঙ্গে জালিয়াতি করেছেন, তা ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসছে। এখনই সাড়ে এগারো হাজার কোটির জালিয়াতির খবর সামনে এলেও, সূত্রের খবর, যে মডাস ওপারেন্ডি ব্যবহার করে পিএনবিকাণ্ডটি সামনে এল, সেটা যদি অন্য ব্যাঙ্কে ব্যবহার করা হয়, তাহলে আরও বিপুল অঙ্কের অর্থ জালিয়াতির খবর সামনে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।


প্রসঙ্গত, পিএনবি-র কার্যপ্রণালীর বিভিন্ন ফাঁকফোকর ব্যবহার করেই এই জালিয়াতি করেন হীরে ব্যবসায়ী। পিএনবি সূত্রে খবর, এরমধ্যেই তারা আরও তিরিশটি ব্যাঙ্ককে লিখিতভাবে খতিয়ে দেখার আবেদন করেছেন, তারাও একই ধরনের জালিয়াতির শিকার কিনা? ঠিক কত টাকার জালিয়াতি করেছেন বিখ্যাত এই হীরে ব্যবসায়ী, সেটা পিএনবি সহ অন্য তিরিশটি ব্যাঙ্কের তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলেই জানা যাবে।

সংশ্লিষ্ট পিএসইউ ব্যাঙ্কের দুই কর্মী, ডেপুটি ম্যানেজার গকুলনাথ শেট্টি এবং কেরানি মনোজ খারাট ব্যাঙ্কের মুম্বইয়ের ব্র্যাডি হাউসের শাখা থেকে একাধিক লেটার অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইস্যু করেন। এলওইউ ইস্যু করা হয় নীরব মোদীর সংস্থা এবং নিজেদের ব্যাঙ্কের মধ্যে। কিন্তু এলওইউ ইস্যু করার জন্যে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, তা মোটেই করা হয়নি। এমনকি, নূন্যতম ক্যাশ রিজার্ভ রাখা হয়নি, লেনদেনের কোনও নথি ব্যাঙ্কের কোর ব্যাঙ্কিং সফটওয়্যারেও রাখা হয়নি। প্রসঙ্গত, এই সফটওয়্যারেই আর্থিক লেনদেনের সমস্ত রেকর্ড রাখা হয়। এলওইউ, মূলত হচ্ছে সেই 'গ্যারেন্টি' যেটা ইস্যুয়িং ব্যাঙ্ক ও যে ব্যাঙ্ক বা সংস্থাকে টাকা দেওয়া হচ্ছে তাদের মধ্যে থাকে।

এবার মোদী এবং তাঁর সংস্থা সেই এলওইউগুলি ব্যবহার করে ভারতের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের হংকংয়ের শাখা থেকে 'বায়ারস ক্রেডিট' তোলে। সেই সমস্ত ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে রয়েছে এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক, অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক এবং স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। সূত্রের খবর, এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক থেকে হীরে ব্যবসায়ী ২০০০-২২০০ কোটি টাকার মতো তুলে ছিলেন, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক থেকে ২০০০-২৩০০ কোটি টাকা, অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক থেকে দু হাজার কোটি এবং এসবিআইয়ের থেকে ৯৬০ কোটি তুলেছেন।

প্রসঙ্গত, এই সমস্ত ব্যাঙ্কের কর্মীরা এলওইউ ইস্যু করে ইন্টারন্যাশনাল ক্যাশ ট্রান্সফার সংস্থা সুইফ্ট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাঙ্ক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) জানিয়ে দেয়। সুইফ্টের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সমস্ত ব্যাঙ্কগুলি একযোগসূত্রে বাধা। কিন্তু এই সুইফ্ট নেটওয়ার্কেই কানেক্ট করা নেই পিএনবির কোর ব্যাঙ্কিং নেট ওয়ার্ক। আর তার জেরেই এবং সেই ফাঁকের সুবিধা নিয়েই পিএনবি কর্মীরা নীরব মোদীর সঙ্গে হওয়া কোনও লেনদেনের রেকর্ড রাখে না।

এই কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত পিএনবির প্রাক্তন কর্মী শেট্টি ২০১৭ সালের মে মাসে অসবর গ্রহণ করেন। এরমধ্যেই প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে ব্যাঙ্কের আরও দশ কর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। পিএনবি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুনীল মেহেতা জানিয়েছেন, জালিয়াতির খবর জানতে পারার পরই ২৯ জানুয়ারি সিবিআইয়ে মামলা দায়ের করা হয়। জাল এলওইউ-র খবর প্রকাশ্যে আসে যখন মোদীর সংস্থা সোলার এক্সপোর্ট, স্টেলার ডায়মন্ডস এবং ডায়মন্ডস আর.ইউ.এস পিএনবি-কে বায়ারস ক্রেডিটের ব্যাপারে প্রশ্ন করেন মধ্য-জানুয়ারিতে।

এরপরই ব্যাঙ্ককর্মী যারা ফোরেক্স ডেস্ক সামলায়, তারা বলে তাদের যেহেতু কোনও প্রাক অনুমোদিত সীমা নেই, তাই তাদের ক্যাস মার্জিন বা কোল্যাটারল জমা দিতে হবে। এর উত্তরেই মোদীর সংস্থার প্রতিনিধিরা বলে, তারা অতীতে বায়ারস ক্রেডিটের সুবিধা পেয়েছে। তখনই শুরু হয় পিএনবির তদন্ত। প্রথম সিবিআই ২৮০ কোটির জালিয়াতি হয়েছে বললেও, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জানা যায় এখনও পর্যন্ত সাড়ে এগারো হাজার কোটির জালিয়াতি চিহ্নিত হয়েছে।

তদন্তকারীদের ধারণা, এক ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাঙ্কের বায়ারস ক্রেডিট মেটাতো মোদীর সংস্থাগুলি। প্রায় ১৫০টি জাল এলওএই ইস্যু করা হয়েছে। প্রথম এলওইউ ইস্যু করা হয় ২০১১ সালে। সাধারণ, এলওইউগুলির ৯০ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে মেয়াদ শেষ হলেও, এক্ষেত্রে সেগুলো ফের ব্যবহার করা হয়েছে। তাই জন্যে জালিয়াতি ধরা পড়েনি গত সাত বছরে।

এরমধ্যেই ইডি মোদীর দেশজুড়ে বিভিন্ন শোরুম, বাড়িতে  তল্লাশি চালিয়ে বহু কোটি মূল্যের হীরে, দামি পাথর, গয়না উদ্ধার করে। যার আনুমানিক মূল্য ৫,১০০ কোটি। সূত্রের খবর, গত ১ থেকে ৬ জানুয়ারির মধ্যে দেশ ছেড়ে পালান নীরব মোদী, স্ত্রী অ্যামি (মার্কিন নাগরিক), নীরবের ভাই নিশল এবং কাকা মেহুল চোকসি। শেষবার নীরব মোদীকে প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল সুইতজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত হওয়া ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে এক ফটোশ্যুটে।