চণ্ডীগড়: প্রচারমূলক ভিডিওতে তাঁকে দেখা যেত গোলাপী বসনে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছেন! আবার বাস্তব জীবনে তাঁকে দেখা গিয়েছে হাই-এন্ড মোটরসাইকেলে চড়ে বিভিন্ন সম্মেলনে যোগ দিতে। মোটরসাইকেলের সঙ্গে মানানসই রঙিন ব্যক্তিত্ব!


তিনি গুরমীত রাম রহিম। ডেরা সচ্চা সৌদার ‘বিতর্কিত’ প্রধান। একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে। সেখানে তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘আধ্যাত্মিক সাধু/মানবপ্রেমী/বহুমুখী গায়ক/সর্বে- সর্বা ক্রীড়াবিদ/চলচ্চিত্র পরিচালক/অভিনেতা/শিল্প নির্দেশক/সঙ্গীত পরিচালক/লেখক/গীতিকার/আত্মজীবনী-রচয়িতা/চিত্রগ্রাহক’!!


তবে, তাঁর ভক্তদের কাছে, তিনি এর চেয়েও বেশি! গত স্বাধীনতা দিবসের দিন তিনি ৫০ বছর পূর্ণ করেন রাম রহিম। ডেরা সচ্চা সৌদার সদর দফতর সিরসায়। এখান থেকেই সব নিয়ন্ত্রণ করতেন রাম রহিম। তাঁর অগণত ভক্তকূল পঞ্জাব, হরিয়ানা ও রাজস্থানে ছড়িয়ে রয়েছে। পাশাপাশি, বিদেশেও রয়েছে তাঁর ভক্তরা।


কিন্তু, শুরুটা কীভাবে হয়েছিল এই তথাকথিত ‘রকস্টার বাবা’-র? জানা যায়, ১৯৬৭ সালের ১৫ অগাস্ট রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগর জেলার শ্রীসুরুসর মোদিয়া গ্রামে জন্ম গুরমীতের। তাঁর বাবা জমির মালিক ছিলেন। একমাত্র সন্তান। ফলে ছেলেবেলা থেকেই বাবাকে খেতের কাজে সহায়তা করতেন তিনি।


শোনা যায়, ছোট থেকেই গুরমীত আধ্যাত্মিক ছিলেন। যখন তাঁর বয়স সাত, তৎকালীন ডেরা প্রধান শাহ সতনাম সিংহের সংস্পর্শে আসেন তিনি। তিনিই গুরমীতকে রাম রহিম উপাধি দেন। ১৬ বছর পর, ১৯৯০ সালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিজের শিষ্যদের ডাকেন সতনাম। সেখানেই রাম রহিমকে তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচিত করেন সতনাম।


সেই থেকে ডেরা প্রধান রয়েছেন রাম রহিম। স্কুল ফাইনাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন রাম রহিম। বিয়ে হয় হরজিত কৌরের সঙ্গে। তাঁদের দুই কন্যা রয়েছে—চরণপ্রীত ও অমনপ্রীত। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এক পুত্রও রয়েছে। নাম জশমীত। পাশাপাশি, একটি মেয়েকে দত্তকও নেন রাম রহিম।


শোনা যায়, রাম রহিম মারাত্মক ঘি ও মাখন পছন্দ করেন। তিনি হামেশা বিভিন্ন ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করতেন। ধর্মগুরু হওয়ার পাশাপাশি, তিনি নিজের ব্যবসায়িক বুদ্ধিকে কাজে লাগান তিনি। ২ বছর আগে ‘এমএসজি’ ব্র্যান্ডের বিভিন্ন দেশী ও জৈব পণ্য বাজারে আসে। ব্যবসা দেখতেন তাঁর সন্তানরা। তাঁরাও সিরসায় ডেরার সদর দফতরের ভিতরই থাকেন।


পরবর্তীকালে এই এমএসজি ব্র্যান্ড থেকেই তাঁর মাথায় প্রথম ছবি ‘মেসেঞ্জার অফ গড’ নামটি আসে। ২০১৪ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। সেখানে রাম রহিমকে নিজের ইমেজ পরিবর্তন করতে দেখা যায়। রাম রহিম হয়ে ওঠেন ‘সুপারহিরো’।


অনেকেই তাঁকে ‘রকস্টার বাবা’ হিসেবেও উল্লেখ করেন। এরপর তাঁর আরও তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। প্রতিটিতেই রাম রহিমকে অন্য রুপোলি পর্দার সুপারহিরোর মতো মারাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাকশন স্টান্ট করতে দেখা গিয়েছে।


যদিও, অনেকের দাবি, এই ইমেজ মেকওভারের নেপথ্যে রয়েছে ডেরা প্রধানের বিরুদ্ধে ওঠা একাধিক যৌন নির্যাতনের অভিযোগ। ২০০২ সালে বিতর্কের সঙ্গে সম্পর্ক শুরু হয় গুরমীতের। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপের অভিযোগ ওঠে। পাশাপাশি, ধর্ষণ, খুন ও বলপূর্বক লিঙ্গচ্ছেদ করার অভিযোগও ওঠে।


সেই বছরই গুরমীতের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়। একইসঙ্গে, দুই বেনামী চিঠিতে এ-ও অভিযোগ করা হয় যে, ডেরা প্রধান দুই সাধ্বীকে যৌন নীপিড়ণ করেছেন। এছাড়া, রাম রহিমের বিরুদ্ধে কখনও সাংবাদিক হত্যা তো কখনও কয়েকজন সাধুকে জোর করে লিঙ্গচ্ছেদ করার অভিযোগ ওঠে।


কিন্তু কোন কিছুতেই রাম রহিমের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। সিরসা থেকে তিনি কার্যত রাজ চালিয়েছেন। সময়ে সময়ে ভক্তদের উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়েছেন। তাঁর ভক্তরাও তাঁকে ভালবেসে ‘পিতাজি’ বলে ডেকে থাকেন।


সিরসা ডেরা—যেখান থেকে রাম রহিম তাঁর রাজপাট চালান, তা প্রায় ১০০০ একর বিস্তৃত। বলা যায়, একটা ছোটখাটো শহর। তার মধ্যে স্কুল, ক্রীড়াক্ষেত্র, হাসপাতাল ও সিনেমা হল রয়েছে। রাম রহিম সর্বদা জেড ক্যাটেগরি নিরাপত্তা চাদর সঙ্গে নিয়ে থাকতেন। সাক্ষাতের আগাম অনুমতি ছাড়া কেউই ডেরা প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে পারতেন না।


তবে, প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন গুরমীত। গোটা বিষয়টির দেখাশোনা করল ডেরার পলিটিক্যাল উইং। যেমন ২০১৪ সালে হরিয়ানায় বিজেপিকে সমর্থন করার ঘোষণা করেছিল তারা।