নয়াদিল্লি: পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে সব শিবিরেই। তার মধ্যেই গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে 'এক দেশ, এক নির্বাচন'। দীর্ঘ দিন ধরেই এই নীতি কার্যকর করতে গলা ফাটিয়ে আসছে বিজেপি। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে ফের সেই নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে নেমে পড়েছে তারা। পাল্টা একজোটে বিরোধিতা করতে নেমে পড়েছে বিরোধীরাও। 'এক দেশ, এক নির্বাচন' নীতি সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিপন্থী, সংবিধানের পরিবন্থী বলে অভিযোগ করছেন তাঁরা। (One Nation, One Election)
কিন্তু একসঙ্গে সব নির্বাচন করা যাবে না, বা একসঙ্গে ত্রিস্তরীয় নির্বাচন করিয়ে নেওয়ায় কোনও গলদ নেই, এই সংক্রান্ত কোনও বিধি কি রয়েছে দেশের সংবিধানে? (Indian Constitution) নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে ঠিক কী বলছে দেশের সংবিধান? ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি নতুন কোনও দাবি নয়। স্বাধীনতার পরও বেশ কয়েক বছর একসঙ্গে সব নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু প্রাদেশিক সত্তা এবং যু্ক্তরাষ্ট্র পরিকাঠামোর কথা মাথায় রেখে পরবর্তী কালে সেই নীতি থেকে সরে আসে দেশ। লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো রাজনীতিকও ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতির বিরোীধিতা করেছেন।
যদিও দেশের সংবিধানে এই সংক্রান্ত কোনও বিধিনিষেধ নেই বলে মত সংবিধান বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের মতে, নীতি আয়োগ তথা প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কমিটির প্রাক্তন OSD কিশোর দেসাইয়ের দাবি, ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি কার্যকর করতে কোনও বাধা নেই সংবিধানে। সংবিধান সংশোধনেও কোনও বাধা নেই। বরং প্রয়োজনে যাতে সংবিধান সংশোধন করা যায়, তার সবরকম ব্যবস্থা রয়েছে।
কিশোর দেসাইয়ের মতে, সংবিধানের ৮৩ (২) নম্বর অনুচ্ছেদে লোকসভার মেয়াদ পাঁচ বছর বলে উল্লেখ রয়েছে। একই ভাবে ১৭২ (১) নম্বর অনুচ্ছেদে বিধানসভার মেয়াদও পাঁছ বছর বলা রয়েছে। তবে পাঁচ বছরই হতে হবে, অন্যথা হওয়া যাবে না, এমনটা বলা নেই কোথাও। নির্ধারিত সময়ের আগেই লোকসভা অথবা বিধানসভা ভেঙে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে না।
লোকসভা নির্বাচন হোক বা বিধানসভা নির্বাচন, মেয়াদ শেষ হওয়ার ছ’মাস আগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দেশের নির্বাচন কমিশন। পঞ্চায়েত এবং পৌরসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজ্যের নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে 'এক দেশ, এক নির্বাচন' নীতি কার্যকর করতে অসুবিধা নেই বলে মত কিশোর দেসাইয়ের।
কিন্তু এই নীতি কার্যকর করতে গেলে সাংবিধানিক বাধা-বিপত্তির মুখে পড়তে হবে বলে মত সংবিধান থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তাঁদের মতে, পঞ্চায়েত, বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ আলাদা হয়। রাজ্যস্তরের নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্থানীয় সমস্যাগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। জাতীয় সমস্যাগুলিকে সামনে রেখে হয় লোকসভা নির্বাচন। একসঙ্গে সব নির্বাচন হলে, আঞ্চলিক দলগুলি স্থানীয় সমস্যা তুলে ধরার কোনও সুযযোগই পাবেন না।
নির্বাচনের খরচ-খরচাতেও জাতীয় দলগুলির সামনে আঞ্চলিক দলগুলি এঁটে উঠতে পারবে না বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। এক্ষেত্রে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারকে আঞ্চলিক দলগুলির আপত্তির মুখে পড়তে হবে। ইভিএম-এর বদলে ব্যালট পেপারে ভোটাভুটির দাবি উঠছে বেশ কিছুদিন ধরেই। মূলত বিরোধীরাই এই দাবি তুলছেন। ব্যালটেই যদি ভোটগ্রহণ হয়, সেক্ষেত্রে একসঙ্গে নির্বাচন হলে ফলাফল জানতে সময় লাগবে অনেকটা।
'এক দেশ, এক নির্বাচন' নীতি কার্যকর হলে, একটি মাত্র দলই লাভবান হবে বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের মতে, সাধারণত কেন্দ্রের হাত দিয়েই বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা হাতে পায় রাজ্যগুলি। বিগত কিছু দিন ধরেই নানা অছিলায় এই টাকা আটকে রাখার অভিযোগ উঠছে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। তাই 'এক দেশ, এক নির্বাচন' নীতি কার্যকর হলে, সুযোগ-সুবিধার কথা মাথায় রেখেই সাধারণ মানুষ কেন্দ্র এবং রাজ্যে একটি দলকেই রাখার পক্ষে ভোট দেবেন, তাতে একটি মাত্র দলই লাভবান হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
কেন্দ্রের বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করারই অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা। শুক্রবার এ নিয়ে পরামর্শের জন্য আট সদস্যের একটি কমিটি গড়েছে কেন্দ্র। কিন্তু তাতে সরকার ঘনিষ্ঠদেরই আধিক্য বলে অভিযোগ উঠছে। লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরীকে কমিটিতে রাখা হলেও, আহ্বান ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, আগে থেকেই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির বন্দোবস্ত করে রেখেছে কেন্দ্র। এখন শুধুমাত্র লোক দেখাতে তাঁকে রাখা হচ্ছে। মোদি সরকার দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের অবমাননা করছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন তিনি।