নয়াদিল্লি: অতিমারির প্রকোপ কেটে গেলেও, নোভেল করোনাভাইরাস নিয়ে আলোচনা থেমে নেই। করোনাকালে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ মারা যান, সেই নিয়ে ধন্দ ছিল এযাবৎ। চার বছর অবশেষে তার উত্তর মিলল বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। কারণ সম্প্রতি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার যে পরিসংখ্য়ান প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গিয়েছ, ২০২১ সালে ভারতে মোট ১ কোটি ২ লক্ষ ২৪ হাজার ৫০৬ জন মারা যান। ২০২০ সালে ওই সংখ্যা ছিল ৮১ লক্ষ ১৫ হাজার ৮৮২। প্রায় ২৬ শতাংশ বেশি মৃত্যু। অর্থাৎ ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে প্রায় ২১ লক্ষ বেশি মানুষ মারা যান। (COVID Deaths)

দীর্ঘ চার বছর অপেক্ষার পর, চলতি সপ্তাহে নথিভুক্ত জন্ম এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে কেন্দ্র। রিপোর্টে বলা হয়েছে, নথিভুক্ত সংখ্যার নিরিখে ২০২০ সালের ৮১.২ লক্ষের তুলনায় ২০২১ সালে মৃত্যুসংখ্যা বেড়ে ১০২.২ লক্ষ হয়, ২৬.০ শতাংশ বৃদ্ধি’। Civil Registration System-এর আওতায় ২০২১ সালে জন্ম ও মৃত্য়ুর যে পরিসংখ্যান মেলে, সেই অনুযায়ীই ২০২১ সালের হিসেব প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ৭৫.৯ লক্ষ মৃত্যু নথিভুক্ত হয়। (COVID Data)

শংসাপত্রে মৃত্যুর কারণের নিরিখে যে হিসেব সামনে এসেছে, সেই অনুযায়ী, ২০২০ সালে কোভিডের জেরে ১ লক্ষ ৬০ লক্ষ ৬১৮ জনের মৃত্যুর উল্লেখ ছিল শংসাপত্রে। ২০২১ সালে মৃত্যুর কারণ হিসেবে কোভিডের উল্লেখ ছিল ৪ লক্ষ ১৩ হাজার ৫৮০ শংসাপত্রে, যার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ২ লক্ষ ৬৭ হাজার ৩৬৩, নারীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ২১৫, ২ রূপান্তরকামী।

কিন্তু মৃত্যুর মেডিক্যাল শংসাপত্র বানিয়েছিলেন ক’জন? জানা যাচ্ছে, ২০২১ সালে যে ১ কোটি ২ লক্ষ ২৪ হাজার ৫০৬ জন মারা যান, তাঁদের মধ্যে মাত্র ২৩ লক্ষ ৯৫ হাজার ১২৮ জনেরই মেডিক্যাল শংসাপত্র বানানো হয়। সেই সংখ্যাও ২০২০ সালের তুলনায় ৫ লক্ষ ৮৩ হাজার ৪৪০ বেশি। ২০২০ এবং ২০২১ সালে কোভিডের জেরে ৫ লক্ষ ৭৪ হাজার ১৯৮ জনের মৃত্যুর পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে রিপোর্টে। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য়মন্ত্রকের যে কোভিড ড্যাশবোর্ড রয়েছে, তাতে ১০ মে সকালেও কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লক্ষ ৩৩ হাজার ৬৬৫ বলে নথিভুক্ত রয়েছে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, মৃত্যুর কারণ হিসেবে ফুসফুস, সংবহনতন্ত্রের রোগের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। মোট মৃত্যুর ২৯.৮ শতাংশই মেডিক্যালি সার্টিফায়েড। ১৭.৩ শতাংশ কোভিডে মৃত্যু, শ্বাসযন্ত্রের রোগে মৃত্যু ১২.৭ শতাংশ, সংক্রামক এবং পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রোগের জেরে মৃত্যু হয় ৬.১ শতাংশের। ২০২১ সালে গোটা দেশের মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে ছিল কোভিড, ২০২০ সালে তা ছিল তৃতীয় স্থানে। 

দেশের ৩২টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়, হরিয়ানা, পঞ্জাব, তেলঙ্গানা, ঝাড়খণ্ড এবং দিল্লিতে। ২০২০ সালে জন্ম নথিভুক্ত হয় ২৪২.২ লক্ষ, ২০২১ সালে সেই সংখ্যা কমে ২৪২ লক্ষ হয়। অর্থাৎ ০.১ শতাংশ পতন দেখা গিয়েছে Civil Registration System-এর রিপোর্টে।

সরকারি রিপোর্ট সামনে আসতেই মুখ খুলেছে বিরোধী দলগুলি। কেরল কংগ্রেসের বক্তব্য, ‘সরকারি ভাবে কোভিডে ৫ লক্ষ ৩৩ হাজার ৬৬৫ মৃত্যু দেখানো হচ্ছে। অথচ সরকারের তথ্যই বলছে ২০ লক্ষ বাড়তি মৃত্যু হয়েছে। চার বছর ধরে সরকার চেপে রাখলেও, শেষ পর্যন্ত সত্য় বেরিয়ে এল’। কোভিড-পরিসংখ্যান নিয়ে আগেও প্রশ্ন তুলেছিল কংগ্রেস।

CPM লেখে, 'যা ভয় ছিল, সরকারি তথ্য, তা-ই দেখাচ্ছে। অতিমারির সময় বাড়তি ২০ লক্ষ মৃত্যু। এটা অপরাধমূলক ভাবে দায়িত্ব থেকে সরে থাকা। কোভিড নিয়ে মোদি সরকার বড় বড় বুলি আউড়েছে, মানবতাকে বাঁচানোর দাবি করেছে। বাস্তবে ব্যর্থ হয় ওরা। আসল পরিসংখ্যানে হেরফের ঘটায়, সত্য বলতে গেলে মুখবন্ধ করতে ছুটে যায়। জবাবদিহি এখনও বাকি'।

সাংসদ ডি রবিকুমারের বক্তব্য়, 'আগে সরকার যা বলেছিল এবং এখন যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে প্রায় ২০ লক্ষের ফারাক দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগেই বলেছিল, বলেছিলেন ডেটা সায়েন্টিস্টরাও। কিন্তু মোদি সরকার অস্বীকার করেছিল। দাবিকে মিথ্য়া বলা হয়েছিল। এখন সত্য সামনে চলে এসেছে। শুধুমাত্র সর্বভারতীয় স্তরেই নয়, তামিলনাড়ুর ক্ষেত্রেও ফারাক দেখা যাচ্ছে। তামিলনাড়ু থেকে ১ লক্ষ ৪০ হাজার মৃত্যু কম দেখানো হয়েছে'।

এর আগে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি-সহ একাধিক সংস্থার রিপোর্টে করোনা মৃতের আসল সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। মোদি সরকার যে পরিসংখ্য়ান দিচ্ছে, বাস্তবে তার চেয়ে অন্তত ১২ লক্ষ বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন বলে দাবি করে তারা। সেই সময় ওই সব রিপোর্টকে খারিজ করে দেয় কেন্দ্র। এতদিন পর সরকারি রিপোর্ট সামনে আসার পর তাই ফের প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।