কৃষ্ণেন্দু অধিকারী, কলকাতা : 'বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে'। বিজেপি নেতাদের বারবার ফোনের ভিত্তিতে ঘনিষ্ঠ মহলে এমনটাই জানিয়েছেন মুকুল রায়। এই মুহূর্তে জানা যাচ্ছে যাবতীয় জল্পনার অবসান করে, দুপুর সাড়ে তিনটের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে বসে তৃণমূল ভবনে সরকারিভাবে ঘাসফুল শিবিরে প্রত্যাবর্তন ঘটতে চলেছে মুকুল রায়ের।
মাঝে বেশ কয়েকদিন ধরেই জল্পনার পারদ তৈরি হলেও শুক্রবার সকালে তা জোর পায়। জানা যায়, তৃণমূল ভবনে রাজ্যের শাসক দলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে হাজির থাকবেন মুকুল রায়। ছেলে শুভ্রাংশু রায়কে নিয়ে ফের ঘাসফুল শিবিরে তাঁর 'ঘর ওয়াপসি'র খবর পেয়েই দলের ন্যাশনাল ভাইস প্রেসিডেন্টকে বিরত করার মরিয়া চেষ্টা চালানো হয় গেরুয়া শিবিরের পক্ষ থেকে। সকাল থেকেই একাধিক বিজেপি নেতারা ফোনে ধরার চেষ্টা করেন মুকুল রায়কে। কিন্তু কারোরই ফোন ধরেননি তৃণমূলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। সূত্রের খবর, ঘনিষ্ট মহলে শুধু জানিয়েছেন, 'বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে।'
গত বেশ কিছুদিন ধরেই বিজেপির একাধিক বৈঠক এড়িয়ে যাচ্ছিলেন মুকুল রায়। যারপর থেকেই তাঁর তৃণমূলের প্রত্যাবর্তনের জল্পনা জোরদার হয়েছিল। যা আরও কিছুটা বেড়ে যায় হাসপাতালে তাঁর অসুস্থ স্ত্রীকে সদ্য নির্বাচিত তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গিয়ে দেখা করে আসার পর থেকে। মুখ্যমন্ত্রীর ফোনে খোঁজ নেওয়া নিয়ে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন মুকুল পুত্র শুভ্রাংশু।
ভোটের ময়দানেও দেখা গিয়েছিল কখনই তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সেভাবে সুর চড়াননি মুকুল রায়। বরং জানা যাচ্ছে, সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকতে চেয়েও যেভাবে তাঁকে গেরুয়া শিবির কৃষ্ণনগর উত্তরের প্রার্থী করেছিল, তা নিয়ে মোটেই খুশি ছিলেন না তিনি। ভোটপর্বের চড়া প্রচারের মাঝে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কখনই সেভাবে কঠোর আক্রমণ করেননি মুকুক রায়কে। বরং সাংগঠনিকভাবে যে অঞ্চলটি মুকুল রায় দেখেন না, সেখানে তাঁকে প্রার্থী করা নিয়ে তাঁর গলায় শোনা গিয়েছিল সহমর্মিতার সুর।
সূত্রের খবর, একদিকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে ভোটের ময়দানে নামানো ও অপরদিকে ক্রমাগত সাংগঠনিক দিকে শুভেন্দু অধিকারীকে বিজেপির বাড়তি দায়িত্ব তুলে দেওয়া নিয়ে খুব একটা খুশি ছিলেন না তিনি। ভোটের আগে থেকেই মুকুল রায়ের যে উষ্মা গেরুয়া শিবিরের প্রতি তৈরি হচ্ছিল, তা সময়ের সঙ্গে আরও বাড়ে।
২০১৭ সালে যখন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন দল ছেড়েছিলেন মুকুল রায়। ঘাসফুল শিবিরের জন্মলগ্ন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ট বলে পরিচিত মুকুল রায় ছিলেন দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। তৃণমূলে থাকাকালীন রেলমন্ত্রক, জাহাজমন্ত্রকের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রক সামলেছিলেন। দীর্ঘদিন রাজ্যসভার সদস্যও ছিলেন। তাঁর হঠাৎ করে তৃণমূল ছাড়ার জেরে বড়সড় ধাক্কা খেয়েছিল ঘাসফুল শিবির। তারপর মুকুল রায়ের হাত ধরে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন একাধিক তৃণমূল নেতা-কর্মী।
তবে মাঝে বয়ে গিয়েছে অনেকটা সময়, পাশাপাশি সদ্য হয়ে যাওয়া বঙ্গ বিধানসভা ভোটে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও প্রবলভাবে চেষ্টা করলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি। বরং আরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যে সরকার গড়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এর মাঝেই রাজ্য বিজেপির শিবিরের ভোটের ফল পর্যালোচনার আড়ালে আবডালে উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বাড়তি হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গও। যা নিয়ে তৃণমূলের পক্ষ থেকেও খোঁচা দেওয়ার সুযোগ ছাড়া হয়নি।
মুকুল রায়ের তৃণমূল ছাড়া যেমন ঘাসফুল শিবিরের কাছে সেই সময় একটা বড় ধাক্কা ছিল, তেমনই এই মুহূর্তে তণার বিজেপি ছাড়া গেরুয়া শিবিরের কাছে বড় ধাক্কা হতে চলেছে। এদিকে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া একাধিক নেতাও ইতিমধ্যে ফের ঘাসফুল শিবিরে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছাপ্রকাশ করে রেখেছেন। অনেকেই সমাজমাধ্যমেও বা সরাসরি জনমানসের মধ্যে বিজেপি নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তাদের দ্বিমত জানাতে পিছপা হচ্ছে না।
জানা গিয়েছে, গত বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালেই তৃণমূলে ফেরার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন মুকুল পুত্র শুভ্রাংশু। কিন্তু সেই সময় ঘাসফুল শিবিরের পক্ষ থেকে কোনও ইচিবাচক প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি। এখন অবশ্য পরিস্থিতি অন্য পর্যায়ে। তাই দলত্যাগীদের দলে ফেরানোর ঘোষিত তৃণমূলের বৈঠক হতে চলেছে মুকুল রায় ও তাঁর পুত্র শুভ্রাংশু রায়ের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তনের মঞ্চ।
এদিকে, জল্পনায় ঘোরাফেরা শুরু করেছে অন্য একটি প্রসঙ্গও। মুকুল রায় যখন তৃণমূল ছেড়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। এবার তিনি বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যখন ফিরছেন, তখন সর্বভারতীয় সেই পদে রয়েছেন ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর যিনি গত বিধানসভা ভোটে ঘাসফুল শিবিরের তারকা প্রচারক হিসেবে চষে বেড়িয়েছিলেন গোটা রাজ্য। সেই অবস্থায় প্রশ্ন তাহলে মুকুল রায়কে দলের কোন পদে পুর্নবাসন দেবে তৃণমূল। এখানেই শোনা যাচ্ছে রাজ্যসভায় ফাঁকা থাকা আসনে হয়তো তৃণমূল ফের মুকুল রায়কে সাংসদ করতে পারে। তবে আপাতত সেই রাস্তা কিছুটা দূরে। কারণ, তাঁর আগে প্রথমে বিধায়ক পদও ছাড়তে হবে মুকুল রায়কে।