নয়াদিল্লি: কলেজ পাস করে একটা টাকরি জোটানো যায় বড় জোর। তাই বলে দু’-দু’বার নাম, বাড়ি, বয়স এবং সর্বোপরি দেশ পরিবর্তন! সচরাচর না ঘটলেও, ২৬ (পরিবর্তিত) বছরের  তাসমিদা জোহরের (Tasmida Johar) জীবনে ঘটে গিয়েছে এতকিছু। শিখতে হয়েছে নতুন ভাষা। তৃতীয় বারের জন্য ফের দেশ বদল হতে চলেছে তাঁর। কারণ একটাই, তিনি ছিন্নমূল রোহিঙ্গা কন্যা। তার মধ্যেই সাফল্যের নজির গড়লেন ছিন্নমূল ওই তরুণী (International Women's Day)।


শিক্ষাই একমাত্র মুক্তির পথ হতে পারে, বিশ্বাস তাসমিদার


আদতে মায়ানমারের বাসিন্দা তাসমিদা। গণহত্যা থেকে বাঁচতে প্রাণ হাতে করে বেরিয়ে এসেছিলেন দেশ থেকে (Rohingya Refugee)। প্রথমে বাংলাদেশের কক্সবাজারে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন।  তার পর শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভারতে পা রাখেন। বিশ্বাস ছিল, শিক্ষাই একমাত্র মুক্তির পথ হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাসে ভর করে দুনিয়া চলে থোড়াই! তাই ঘাত-প্রতিঘাতে বার বার দগ্ধ হতে হয়েছে।


সেই যন্ত্রণা বুকে নিয়েই সাফল্য়ের নজির গড়লেন তাসমিদা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেন তিনি, ভারতে বসবাসকরী একমাত্র রোহিঙ্গা কন্যা হিসেবে। দূরশিক্ষা মাধ্যমেই পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেছেন তাসমিদা। কিন্তু সেই প্রাপ্তিতেই মন ভরে গিয়েছে তাঁর। এই মুহূর্তে কানাডার উইলফ্রিড লরিয়ের ইউনিভার্সিটি-র চিঠির জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। গৃহীত হলেই নিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে অনেকটা এগিয়ে যাবেন বলে আশা। সব ঠিক থাকলে, এ বছর অগাস্টেই কানাডা পাড়ি দেবেন।


তাসমিদা জানিয়েছেন, আসলে তাঁর বয়স ২৪ বছর। মায়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে মেয়েদের বয়স বাড়িয়ে দেখানোর রীতি রয়েছে, যাতে তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া যায়। কারণ সে দেশে ১৮ পেরোলেই মেয়ের বিয়ে দেওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। তাসমিদা আসল নামও নয় তাঁর। মায়ানমারে রোহিঙ্গা কন্যাদের পড়াশোনার সুযোগ নেই। তাই তাসমিন ফতিমা থেকে বৌদ্ধ নামের সঙ্গে মিলিয়ে, তাসমিদা জোহর হয়েছেন।


তাসমিদা জানিয়েছেন, মায়ানমারের মানুষের মতে, রোহিঙ্গাদের কোনও অস্তিত্বই কাম্য নয়। কোথাও যদি স্কুলে ভর্তি হওয়াও যায়, আলাদা শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ থাকে রোহিঙ্গা কন্যাদের জন্য। পরীক্ষাকেন্দ্রেও পৃথক বসার জায়গা বরাদ্দ হয়। পরীক্ষায় প্রথম হলেও, মেধা তালিকায় নাম দেখানো হয় না। কলেজে পড়তে চাইলে দেশের সাবেক রাজধানী ইয়াংগন  যাওয়া বাধ্যতামূলক, যাতে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকেন, তার জন্যই এমন নিয়ম বলে মত তাসমিদার।


আরও পড়ুন: International Women's Day: ব্লেডের ভরে তুখোড় দৌড়, শিহরণ জায়গায় কিরণের রূপকথা


কিন্তু এত ঝক্কিই সার, কলেজ পাস করলেও মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের চাকরি জোটে না বলে জানিয়েছেন তাসমিদা। মায়ানমারে  সরকারি চাকরিই কর্মসংস্থানের মূল মাধ্যম। সেখানে রোহিঙ্গারা সম্পূর্ণ ব্রাত্য বলে জানিয়েছেন তাসমিদা। ভোটাধিকার তো নেই-ই। তাই পড়াশোনার ইচ্ছে থাকলেও, মায়ানমারে রোহিঙ্গা কন্যারা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই পড়াশোনা করতে পারেন। হিজাব পরা নিষিদ্ধ। তাতে উল্টো পরিস্থিতি। মেয়ে বাইরে বেরোলে বিয়ে নিয়ে সমস্যায় হয়।


সাত ভাইবোনের মধ্যে তাসমিদা পঞ্চম, মা-বাবার একমাত্র কন্যা। তবে মেয়ের স্বপ্নভঙ্গ হোক চাননি তাঁরাও। তাসমিদার বড় দাদা একমাত্র স্নাতকোত্তর রোহিঙ্গা, এই মুহূর্তে যিনি ভারতে রয়েছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণানর্থী বিভাগে কর্মরত। ছিন্নমূল রোহিঙ্গাদের জন্য অনুবাদকের কাজও করেন। বাকি পাঁচ দাদা এবং বাবা দিল্লিতে দিনমজুরের কাজ করেন।  


২০০৫ সালে মায়ানমার ছাড়েন তাসমিদা। বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। একাধিক বার জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁর বাবাকে জেলে ভরে দিয়েছিল মায়ানমার পুলিশ। প্রথমে কক্সবাজারে ছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া পরিচয়পত্র মেলেনি। বাংলাদেশের স্কুলেও ভর্তি হতে চেয়েছিলেন তাসমিদা। কিন্তু মায়ানমারের শিক্ষা সে দেশে গ্রাহ্য হয়নি। তাই ফের প্রথন শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করতে হয় তাসমিদাকে।


ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলাদেশে পড়াশোনা করেন তাসমিদা। তার পর, ২০১২ সালে ভারতে চলে আসেন। সে বার রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে শরণার্থী পরিচয়পত্র হাতে পান তাঁরা। প্রথমে হরিয়ানার শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই হয়। তার পর দিল্লিতে এক আত্মীয়র বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু ভারতে ভাষার সমস্যা ছিল, তাই নতুন করে ভাষাও শিখতে হয়। বর্তমানে হিন্দি, বাংলা, উর্দু বলতে পারেন তাসমিদা। ইংরেজিও শিখেছেন।


আবারও নতুন করে জীবন শুরুর লড়াই


আইনজীবী হতে চান তাসমিদা। ভারতে তার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অনুমোদন নিতে হতো শরণার্থী তাসমিদাকে। হাজার চেষ্টা করেও, তা জোগাড় করতে পারেননি তিনি। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্বপ্নপূরণে শেষ মেশ সহায়ক হয় রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং জার্মান সরকার। তাদের যৌথ সাহায্যেই ভারতে পড়াশোনা শেষ করেছেন। গতবছর সাত জন আফগান এবং তিন জন রোহিঙ্গা রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে বিদেশে পড়ার সুযোগ পান, তাসমিদা তাঁদের মধ্যে একজন। কিন্তু কানাডায় গিয়েও ফের নতুন করে শুরু করতে হবে তাঁকে। আবারও স্নাতকস্তরের পড়াশোনা করতে হবে তাঁকে। তবে তাসমিদার বিশ্বাস, কানাডায় গেলে দুর্দশা ঘুচবে তাঁদের।