কলকাতা: ছোট থেকেই পড়াশোনায় তুখোড়। প্রতি ধাপে ভাল রেজাল্ট। পড়াশোনার শেষে কাজ শুরু করেছিলেন বহুজাতিক সংস্থায়। আর পাঁচটা মেয়ের মতোই তাঁরও স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার। তাই বাড়ি থেকে বহুদূরে হায়দরাবাদে এসেছিলেন চাকরি করতে। কিন্তু জীবনে তো কালো অধ্যায়ও থাকে....
সালটা ২০১১, তাঁর ২৫তম জন্মদিন কিংবা তার আশপাশের কোনও একটি দিন। হায়দরাবাদ থেকে ফরিদাবাদের বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরেছিলেন তিনি। ট্রেনের দরজার ধারে দাঁড়িয়ে থাকার সময় দুই ছিনতাইবাজ হামলা চালায়। ব্যাগ নিতে গেলে প্রতিরোধ করেন তিনি। তখনই তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দেয় দুষ্কৃতীরা। তারপর যখন তাঁর জ্ঞান ফেরে তখন দেখেন বাঁ পা হাঁটুর নীচ থেকে বাদ পড়েছে।
কাট টু...
২০১৪ সাল। সেই হায়দরাবাদ। সেখানেই এয়ারটেল ম্যারাথনে নামতে দেখা গেল এক মহিলাকে। যাঁর বাঁ পায়ের হাটুর নীচ থেকে প্রস্থেটিক পা লাগানো। তিনি জিতলেন, মেডেলও পড়লেন। হাততালির আওয়াজে ঢেকে গেল সব।
ইনি কিরণ কানোজিয়া (Kiran Kanojia)। তাঁর আরও একটি নাম রয়েছে। 'India's Blade Runner'. ক্রীড়াজগতে একাধিক সাফল্য এখন তাঁর মুকুটে। এমন সাফল্যের আলোর পিছনে রয়েছে ২০১১ থেকে ২০১৪- এই সময়ে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং লড়াই। কিন্তু এত মানসিক শক্তি তিনি কীভাবে পেলেন? তার উত্তর লুকিয়ে কিরণের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার লড়াইয়ের মধ্যেই।
হরিয়ানার ফরিদাবাদের মেয়ে কিরণ কানোজিয়া। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় কিরণ। বাবা-মা সবসময়েই চাইতেন তাঁদের তিন সন্তানই যেন পড়াশোনা করে ভাল চাকরি করে। একটি সাক্ষাৎকারে কিরণ জানিয়েছিলেন, তাঁর বাবা-মা খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু সন্তানদের পড়াশোনায় তাঁদের উৎসাহের কমতি ছিল না। দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করার পরে সেভাবে তাঁদের হাতে আর পড়াশোনা করানোর টাকা ছিল না। তখন কিরণের কাকা রোহতকের DAV কলেজের কাছে যায়, কলেজ কর্তৃপক্ষ স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে। প্রথম সিমেস্টারেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন কিরণ। তা দেখে বাকি ২ বছরের জন্য়ও যাবতীয় ফি মকুব করে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। তারপর বেশ কিছু বছর বেশ ভালভাবেই কেটেছে। ২০০৮ সালে ক্যাম্পাসিংয়ের মাধ্যমে ইনফোসিসে চাকরির সুযোগ আসে। কিন্তু সেইসময়েই হানা দিয়েছে আর্থিক মন্দা। আটকে গিয়েছিল অফার লেটার। তারপর একসময়ে সেই অপেক্ষাও শেষ হয়, মাস ছয়েক পর আটকে থাকা অফার লেটার পাঠায় ইনফোসিস। সেই চাকরির সূত্রেই ফরিদাবাদ থেকে হায়দরাবাদে পাড়ি কিরণের।
তারপর ২০১১ সালের ডিসেম্বর। জন্মদিনটা বাড়ির সঙ্গেই কাটানোর জন্য ট্রেনে করে ফরিদাবাদে ফিরছিলেন কিরণ। তখনই ট্রেনে ছিনতাইবাজের আক্রমণের শিকার হন তিনি। ব্যাগ ছিনতাই হওয়া আটকাতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের ধাক্কায় চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে যান তিনি। রেল পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। গোটা জন্মদিন কাটে হাসপাতালেই। তাঁকে বাঁচাতে ক্ষতিগ্রস্ত পা বাদ দিতে হয়। ওই ঘটনায় গোটা পৃথিবীটাই নড়ে গিয়েছিল কিরণের। কিন্তু আশা হারাননি। সেই অন্ধকার সময়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল তাঁর পরিবার। এই অবস্থায় কীভাবে চাকরি করবে, কীভাবে বাঁচবে? এমন নানা প্রশ্ন মাথায় ভিড় করে আসছিল। একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে কিরণ জানাচ্ছেন, সেই সময় তাঁর বাবা তাঁকে সুধা চন্দ্রনের উদাহরণ দিয়েছিলেন। তিনি পা বাদ যাওয়ার পরেও কৃত্রিম পায়ের সাহায্যে মঞ্চে ফিরেছেন। ওই উদাহরণ কিরণের মনে আশার আলো জ্বেলেছিল।
দৌড়নোর চ্যালেঞ্জ:
দুর্ঘটনার পরে হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওজন বাড়ছিল। কৃত্রিম পা যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ। ওজন বাড়লে সেই অনুযায়ী নতুন পা লাগবে। এই সময় কিরণের ভরসা হয়ে উঠেছিল হায়দরাবাদের রিহ্যাবিটেশন সেন্টার (Dakshin Rehab). সেখানেই জীবনের নতুন মানে খুঁজে পান কিরণ। সেখানেই এক ডাক্তার তাঁকে দৌড়নোর স্বপ্ন দেখান। কৃত্রিম পায়ের বদলে কিরণকে ব্লেড ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তার উপর ভর দিয়েই শুরু হয় কিরণের নতুন দৌড়। সেই সময় ওই গ্রুপটি নিজেরাই দৌড়নোর অভ্যাস করত। তা দেখে লোকজন উৎসাহ জোগাতে থাকায় ধীরে ধীরে ৫ কিলোমিটারের বদলে ১০ কিলোমিটার দৌড়নোর অভ্যাস (Blade Runner) করেন তিনি। তারপর শুরু করেন ২১ কিলোমিটার দৌড়ের অভ্যাস।
একাধিক সাফল্য:
২০১৭ সালে NITI Aayog এবং United Nations-এর আয়োজনে Women Transforming India Award-জেতেন কিরণ। ওই বছরেই Mission Smile-এর ক্যালেন্ডারে জায়গা পান কিরণ। রয়েছে আরও নানা কীর্তি।
অলিম্পিকের স্বপ্ন:
প্যারা অলিম্পিকে (Para Olympic) যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন কিরণ। কিন্তু তার জন্য অর্থ চাই, ট্রেনিং চাই। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিলে পরিবারে আর্থিক সমস্যা তৈরি হবে। কিন্তু তাতে মন খারাপ হয় না কিরণের। ওই দুর্ঘটনার পরে যে ম্যারাথনে দৌড়তে পারবেন সেটা কখনও ভাবেননি। সেটা যখন হয়েছ, তখন প্যারা অলিম্পিকও একদিন হবে। আশা রাখেন কিরণ। রূপকথা কেমন হয়? সত্যিই কি হয়? উদাহরণ এই কিরণ কানোজিয়া।
আরও পড়ুন: ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল, বাদ যায় পা- তারপর? এভারেস্ট জয়