জয়পুর: তদানীন্তন সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন রাজা রামমোহন রায় এবং লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। তাই বলে ভারতীয় সমাজ থেকে সতীদাহ প্রথা একেবারে উঠে যায়নি। খাতায় কলমে চার দশক আগেও দেশে সতীদাহের নজির রয়েছে। সেই সংক্রান্ত মামলায় এবার আট অভিযুক্ত খালাস পেয়ে গেলেন। প্রমাণের অভাবে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে গেলেন তাঁরা। (Roop Kanwar Case)


১৯৮৭ সালের ঘটনা। রাজস্থানের দিবরালার বাসিন্দা মাল সিংহের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সি রূপ কানওয়ারের। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে রূপ ছিলেন কনিষ্ঠতম। জানুয়ারিতে বিয়ে হয় তাঁর। মাত্র আট মাসের মাথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন মাল। সিকারের হাসপাতালে ভর্তি করলে মারা যান তিনি। এর পর, ৪ ডিসেম্বর স্বামীর চিতায় উঠে 'সতীত্ব' বরণ করেন রূপ। (Last Sati Case)


বিষয়টি সামনে আসতে সেই সময় ব্যাপক শোরগোল পড়ে যায়। সতীদাহ প্রথা বিরোধী বিশেষ কমিশন অফ সতী প্রতিরোধ আইন আনা হয় এই ঘটনার পর। এর পরও, ১৯৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর, যেদিন রূপ 'সতীত্ব' বরণ করেন, সেই দিন বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সতীদাহ প্রথার মহিমাকীর্তন চলে সেখানে, যা ছিল আইনের পরিপন্থী। সতীদাহ প্রথার মহিমা কীর্তনে সাত বছরের জেল, ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার নিদান ছিল।


সেই মামলা আদালতে উঠলে ক্রমশ বাড়তে থাকে জটিলতা। সতীদাহ প্রথার মহিমা কীর্তনই নয় শুধু, অভিযোগ ওঠে, নিজের ইচ্ছেয় স্বামীর চিতায় ওঠেননি রূপ। তাঁকে 'সতীত্ব' বরণে বাধ্য করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে মামলা দায়ের করা নিয়েও টানাপোড়েন চলে। রাজনৈতিক প্রভাবের তত্ত্ব সামনে আসে। শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে পড়ে মামলা দায়ের করা হয়। সেই সময় রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন হরদেব জোশী। গোটা ঘটনায় তাঁর সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। রাজস্থানে তাঁর ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার নেপথ্যে এই ঘটনাকে দায়ী করা হয়।


তদন্তে উঠে আসে, স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় ওঠেননি রূপ। জীবন্ত তাঁকে জ্বালিয়ে দওয়া হয়। গোটা গ্রাম সেই দৃশ্য দেখতে হাজির হলেও, কেউ প্রতিবাদ জানাননি। বরং বহু দূর থেকে সাধু-সন্তরাও ওই দৃশ্য দেখতে ছুটে আসেন। 'সতীত্ব' বরণকারী রূপ আসলে কোনও দেবী কি না, দেখতে আসেন তাঁরা। রীতিমতো বিয়ের সাজে সাজিয়ে, শ্বশুরবাড়ির আশীর্বাদ-সহ গোটা গ্রামে প্রথমে নারকেল হাতে ঘোরানো হয় রূপকে। 


রূপ 'সতী' হতে যাচ্ছেন বলে গোটা গ্রামে আগে থেকেই চাউর হয়ে গিয়েছি। 'রাজপুত শ্মশান ঘাটে' তাই উপচে পড়ছিল ভিড়। ১৫ মিনিট ধরে প্রথমে স্বামীর চিতার চারিদিকে ঘোরানো হয় রূপকে। উপস্থিত লোকজনকে বলতে শোনা যায়, "তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেল। পুলিশ এসে পড়বে নইলে।" এর পর চিতার উপর বসিয়ে দেওয়া হয় রূপকে। কোলে রাখা হয় মৃত স্বামীর মাথা। এর পর চিতায় যখন আগুন ধরানো হয়, ঝলসে চিৎকার করতে থাকেন রূপ। চিতা থেকে একবার পড়েও যান তিনি। চিৎকার করতে থাকা অবস্থায় ফের তাঁকে চিতায় তুলে দেওয়া হয়। গ্রামের প্রায় প্রত্যেক ঘর থেকে বালতি করে ঘি এসে পৌঁছয় শ্মশানে। সেই ঘি চিতার উপর ঢালা হচ্ছিল। 


এর পর রূপের নামে এলাকায় 'সতী দেবী'র মন্দির তৈরি করে সেখানে 'চুনরী মহোৎসবের'ও আয়োজন করা হয়। এতেই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঘটনা। সমাজকর্মীরা সেই নিয়ে রাজস্থান হাইকোর্টকে চিঠি দেন। আদালত  উৎসব বন্ধের নির্দেশ দেয়, সরকারকে পদক্ষেপ করতে বলে। কিন্তু তার পরও ১০ হাজার জনসংখ্যার ওই গ্রামে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ উৎসবে অংশ নেন।  এত মানুষ দেখে পুলিশও গ্রামের ধারেকাছে ঘেঁষেনি। এমনকি রাজ্যের বেশ কয়েকজন বিধায়কও ওই উৎসবে অংশ নেন বলে সামনে আসে। এর পর, ১৯৮৮ সালে ওই ঘটনার বর্ষপূর্তিও পালন করা হয়। লরিতে চেপে জয়োধ্বনি দিতে দিতে এলাকায় এসে পৌঁছন মানুষজন। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত মামলার শুনানির জন্য আবেদন জমা পড়ে আবেদন। 


প্রথমে মোট ৪৫ জন অভিযুক্তের নাম জমা পড়ে আদালতে। প্রমাণের অভাবে ২০০৪ সালে ২৫ জন মুক্তি পেয়ে যান। আটজন মারা গিয়েছেন আগেই। বুধবার আদালত আটজনকে মুক্তি দিয়েছে। এখনও চার জন পলাতক। জয়পুরের সতী নিবারণ আদালতের বিশেষ বিচারক অক্ষি কংশল মহেন্দ্র সিংহ, শ্রবণ সিংহ, নিহাল সিংহ, জিতেন্দ্র সিংহ, উদয় সিংহ, দশরথ সিংহ, লক্ষ্ণ সিংহ এবং বনবর সিংহ নামের চারজনকে খালাস করেছে। যদিও আগে থেকেই জামিনে মুক্ত ছিলেন তাঁরা। 


অভিযুক্তদের আইনজীবীর বক্তব্য, "আদালত আটজনকে মুক্ত করেছে। আদালত জানিয়েছে, সরকারি আইনজীবী আদালতে সন্দেহ প্রকাশ করা ছাড়া, তথ্যপ্রমাণ পেশ করতে পারেননি। তাই প্রমাণের অভাবে ওই আটজনকে মুক্ত করা হচ্ছে।" তাঁর দাবি, সতীদাহের চেষ্টার যে মামলা দায়ের হয়, অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি সরকারি কৌঁসুলি। সতীদাহ হয়েছিল বা তার মহিমা কীর্তন হয়েছিল বলেও কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেননি তদন্তকারীরা। রূপের দাদা গোপাল সিংহ রাঠৌরের দাবি, নিজের ইচ্ছেতেই 'সতীত্ব' বরণ করেন রূপ। কেউ তাঁকে প্ররোচিত করেননি, উস্কানিও জোগাননি। পরিবারের কেউ কোনও অন্যায় করেননি, সরকারও চার দশকে কিছু প্রমাণ করতে পারেননি বলে মন্তব্য করেন তিনি।