নয়াদিল্লি: হাতে মাত্র আর কয়েক দিন। বয়স হবে ৭৫ বছর। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে কি তাহলে অবসর নেবেন নরেন্দ্র মোদি? কয়েক মাস আগে পর্যন্ত এই প্রশ্নে সরগরম ছিল জাতীয় রাজনীতি। বয়সের দরুণ লালকৃষ্ণ আডবানি, মুরলি মনোহর জোশীদের সরতে হলে, মোদি কেন সরবেন না, প্রশ্ন তুলছিলেন অনেকেই। সেই নিয়ে বিতর্ক যখন তুঙ্গে, আগুনে ঘি ঢেলেছিল মোহন ভাগবতের একটি মন্তব্য। তাঁর বক্তব্য় ছিল, 'বয়স ৭৫ হলে থেমে যাওয়া উচিত'। এতদিন পর সেই নিয়ে মুখ খুললেন ভাগবত। তাঁর দাবি, কাউকে অবসর নিতে বলেননি তিনি। (Mohan Bhagwat on Narendra Modi Retirement)
দিল্লিতে আয়োজিত সাংবাদিক বৈঠকে বেশ কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হন ভাগবত। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, "বয়স ৭৫ হলে, কাঁধে শাল উঠলে, বুঝতে হবে বয়স হয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির দিকেই আপনি ইঙ্গিত করেছিলেন বলে মনে করেন অনেকে। পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও কি এই ৭৫ বছর বয়সের নিয়ম কার্যকর? সংসারী-গৃহস্থরা কি সঙ্ঘ চালাতে পারেন?" উত্তরে ভাগবত বলেন, "এখানে তথ্যে খামতি রয়েছে। শ্রীমান ভাইয়াজি দানি দীর্ঘ সময় ধরে, সবচেয়ে কঠিন সময়ে সঙ্ঘের দায়িত্বে ছিলেন। উনি ভাল কৃষক ছিলেন, সংসারী মানুষ ছিলেন। গৃহস্থ কাজ করতে পারবেন না, বা এখানে আসতে পারবেন না এমন নয়। কিন্তু এখানে এলে সময় দিতে হয়, সংসারেও সময় দিতে হয়। সঙ্ঘ চায়, যে কাজই করুন, ভাল করে করুন। ওঁর সংসার ভাল চলছিল। কারও হাতে দায়িত্ব দিয়ে আসতে পেরেছিলেন উনি। আমার মতো ভাষণ দেওয়া অনিলজিও সংসারী। সঙ্ঘে ৩৫০০ প্রচারক রয়েছেন। ছোট-বড় মিলিয়ে কার্যকর্তার সংখ্যা ৫-৭ লক্ষ। সেই নিরিখে আমরাই আশাহীন সংখ্যালঘু। ঘর-সংসার নেই বলেই সর্বক্ষণ আছি, আমাদের উপর দায়িত্ব বেশি। আসলে গৃহস্থ লোক আমাদের কাঁধে বোঝা চাপিয়ে, পিছন থেকে পরিচালনা করছেন। বাজার ওঁরা করবেন, মালপত্র আমাদের কাঁধে। আমরা ওঁদের শ্রমিক। আমাদের এখানে বসিয়ে প্রণাম করেন। সঙ্ঘ আসলে বড় বিচিত্র। ভিতরে প্রবেশ করলেই বুঝবেন।" (RSS News)
সঙ্ঘের একসময়ের প্রচারক মোরোপন্ত পিঙ্গলকে উদ্ধৃত করেই ৭৫ বছর বয়সে হাত তুলে নেওয়ার কথা বলেছিলেন ভাগবত। কিন্তু এদিন তিনি বলেন, "মোরপন্ত বড় রসিক ছিলেন। একবার এক অনুষ্ঠানে আমরা সকলে ছিলাম। ওঁর বয়স ৭৫ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় ওঁর কাছে শাল জড়িয়ে দেওয়া হয়। কিছু বলতে বলা হয় ওঁকে। এতে উনি বলেন, 'আপনাদের হয়ত মনে হচ্ছে সম্মান জানাচ্ছেন। কিন্তু আমি জানি, শাল দেওয়ার অর্থ বয়স হয়ে গিয়েছে। চেয়ারে বসে দেখে কী ঘটছে'। উনি এমনই রসিক ছিলেন। নাগপুরে ওঁর জীবনী প্রকাশের অনুষ্ঠানে ইংরেজিতে কথা বলছিলাম। ওঁর বুদ্ধিমত্তা বোঝাচ্ছিলাম। আমি কখনওই বলিনি যে, আমি অবসর নেব, বা অন্য কারও অবসর নেওয়া উচিত। সঙ্ঘে আমরা সকলেই স্বয়মসেবক। আমরা চাই বা না চাই, সকলকেই কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমার বয়স যদি ৮০ হয়, সঙ্ঘ যদি বলে যাও একিট শাখা চালাও, আমাকে করতেই হবে। সঙ্ঘ যা বলে, আমরা তা-ই করি। আমি ৭৫ বছর বয়সের কথা বলতে পারব না, অবসরযাপনের কথা বলতে পারব না। আবার ৩৫ বছর বয়স হলেও অফিসে বসে কাজ করতে বলতে পারে সঙ্ঘ। আমরা নিজের ইচ্ছে জানাতে পারি না। আমাদের কিছু অর্জন করার নেই। আমি সরসঙ্ঘচালক। কিন্তু আমিই কি একা যে এই পদে বসতে পারি। অন্তত ১০ জন এখানেই রয়েছেন। ওঁরা এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। প্রত্যেকেরই কিছু দায়িত্ব রয়েছে। তাই কোনও একজন বা আমার নিজের অবসরের বিষয় নয়। আমরা অবসরও নিতে পারি, কাজও করতে পারি, যতদিন সঙ্ঘ চাইবে আমরা কাজ করি।"
বয়স ৭৫ হলে গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকার রীতি বহুদিন ধরেই চলে আসছে সঙ্ঘে। লালকৃষ্ণ আডবানি, মুরলি মনোহর জোশী, যশবন্ত সিংহদের সেই কারণেই নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা 'মার্গদর্শক মণ্ডলী'তে পাঠিয়েছিলেন বলে প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু সঙ্ঘের সেই আদর্শ মোদি মানবেন কি না, বেশ কিছুদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছিল। সেই আবহেই জুলাই মাসে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন ভাগবত। তাঁর বক্তব্য ছিল, "মোরোপন্ত বলেছিলেন, বয়স ৭৫ হলে কাঁধে যখন শাল ওঠে, তখন থেমে যাওয়া উচিত। এর মানে আপনার বয়স হয়েছে। সরে যান। আমাদের কাজ করতে দিন।" মোদিকে নিশানা করেই তিনি এই মন্তব্য করেন বলে জল্পনা শুরু হয় সেই সময়। এমনকি, ১১ সেপ্টেম্বর ভাগবতের নিজেরও বয়স ৭৫ হচ্ছে। তিনিও আর সঙ্ঘপ্রধানের দায়িত্বে থাকতে চান না বলেও শোনা যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ তো বটেই, শিবসেনার সঞ্জয় রাউতও বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন। মোদি-শাহের আমলে সঙ্ঘের আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিবিশেষ বড় হয়ে উঠেছেন, তাই ভাগবত আসলে মোদিকে অবসরের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বলে দাবি করেন তাঁরা।
কিন্তু বয়সের দরুণ মোদি আদৌ মসনদ ছাড়বেন কি না, সেই নিয়ে বিজেপি-র অন্দর থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। পরিস্থিতি এমন হয় যে দলের সাংসদ নিশিকান্ত দুবে সরাসরি জানিয়ে দেন, মোদির বিজেপি-কে প্রয়োজন নেই, বিজেপি-র মোদিকে প্রয়োজন। মোদি না থাকলে পরের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ১৫০টি আসনও পাবেন না বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু এবার আর নিশিকান্ত বা বিজেপি-র কোনও নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ নন, খোদ ভাগবত জানালেন, কারও অবসরের কথা বলেননি তিনি।