নয়াদিল্লি: জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল তথা প্রবীণ বিজেপি নেতা সত্যমালিক প্রয়াত। মঙ্গলবার ৭৯ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। কিডনির সমস্যায় বেশ কিছু দিন ধরেই ভুগছিলেন সত্যপাল। দিল্লির রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানেই আজ মৃত্য়ু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। পুলওয়ামা হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সমালোচনা করে খবরের শিরোনামে উঠে আসেন তিনি। (Satyapal Malik News)
উত্তরপ্রদেশের বাগপতে জাঠ পরিবারে জন্ম সত্যপালের। জাঠ নেতা হিসেবেই রাজনীতিতে জায়গা করে নেন তিনি। ছাত্র রাজনীতিতে কেরিয়ার শুরু করেন। চৌধরি চরণ সিংহের ভারতীয় ক্রান্তি দল থেকে ১৯৭৪ সালে প্রথমবার বিধায়ক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে জনতা দলের হয়ে আলিগড় লোকসভার সাংসদও নির্বাচিত হন তিনি। হন রাজ্যসভার সাংসদও। (Satyapal Malik Dies)
এর পর প্রথমে কংগ্রেসে যোগ দেন সত্যপাল, তার পর লোকদল এবং সমাজবাদী পার্টিতেও যোগদান করেন। ২০০৪ সালে বিজেপি-তে যোগ দেন সত্যপাল। ২০১৭ সালে বিহারের রাজ্যপাল নিযুক্ত হন, পরে ওড়িশার অতিরিক্ত দায়িত্বও পান। ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। সেই সময় জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ছিল। তিনি রাজ্যপাল থাকাকালীনই ২০১৯ সালে উপত্যকার রাজ্যের স্বীকৃতি খর্ব করা হয়, জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষিত করা হয়। তার পরও গোয়া এবং মেঘালয়ের রাজ্যপাল নিযুক্ত হন তিনি।
বছর দুয়ের আগে মোদির বিরুদ্ধে মুখ খুলে আলোড়ন ফেলে দেন সত্যপাল। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি উপত্যকায় CRPF জওয়ানদের কনভয়ে জঙ্গি হামলা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সরাসরি মোদি-শাহকে কাঠগড়া তোলেন তিনি। বলেন, "সার্বিক ব্যর্থতা ছিল (পুলওয়ামা হামলা)। ৩০০ কেজি আরডিএক্স নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল গাড়ি, যা নিয়ে পরে সিআরপিএফ-এর কনভয়ে হামলা হয়। পাকিস্তান থেকে আনা আরডিএক্স নিয়ে ১০-১৫ দিন ধরে উপত্যকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল গাড়িটি।"
সত্যপাল জানান, ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১১ বার গোয়েন্দাদের কাছ থেকে সতর্কবার্তা এসেছিল। পুলওয়ামা ও লেথপোরায় হামলা হতে পারে বলে জানানো হয়েছিল। যে রাস্তায় জওয়ানদের উপর হামলা হয়, তা নিয়েও সতর্ক করা হয়েছিল। তার পরও সেনার কনভয়কে ওই রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ১০০০ জনের বিরাট কনভয়কে আকাশপথে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। পাঁচটি বিমান চাওয়া হয়। সেই আবেদন গৃহীত হয়নি বলে জানান তিনি।
শুধু তাই নয়, সত্যপালের দাবি ছিল, নিরাপত্তায় যে ঘাটতি ছিল, তা মোদিকেও জানান তিনি, কিন্তু তাঁকে নীরব থাকতে বলেন মোদি। সত্যপাল বলেন, "আমাদের ভুলেই যে হামলা হয়েছে, তা ওই বিকেলেই প্রধানমন্ত্রীকে বলি আমি। জানাই, বিমানে জওয়ানদের নিয়ে গেলে এত বড় বিপদ ঘটত না। কিন্তু উনি বলেন, 'আপনি এখন চুপ থাকুন। যা বলার খবরের চ্যানেলকে আমি বলে দিয়েছি। আপনি এ নিয়ে কথা বলবেন না। এটি একটি অন্য বিষয়'।"
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালও তাঁকে চুপ থাকার নির্দেশ দেন বলে জানান সত্যপাল। তাঁর বক্তব্য ছিল, "অজিত ডোভাল বলেন, 'সতপাল ভাই, এ নিয়ে কথা বলবেন না আপনি। দয়া করে মুখ বুজে থাকুন'। আমি জানতাম পাকিস্তানকে দোষারোপ করা হবে। তাই আমার চুপ থাকা উচিত।" ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পুলওয়ামা হামলা যে বিজেপি-র জয়ের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তাতেও সায় দেন সত্যপাল।
পুলওয়ামা হামলার সত্যতা কোনও দিন সামনে আসবে কি না জানতে চাওয়া হলে, সত্যপাল সেই সময় বলেন, "সত্য লুকিয়ে রাখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে সরকারের। সেটিকে অন্য কাজে ব্যবহার করা হতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক ওই ঘটনাকে অন্য কাজে তো ব্যবহার করা হয়েছে। ঘটনার শিকড়ে না পৌঁছে, রাজনৈতিক ফায়দার জন্য অন্যকে দোষারোপ করা হয়।" কৃষক আন্দোলনের সময়ও মোদি সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন সত্যপাল। উপত্যকার জলবিদ্যুৎ দুর্নীতি মামলায় চলতি বছরই সত্যপালের নামে চার্জশিট দেয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা CBI.
সত্যপালের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লেখেন, 'সত্যপাল মালিকজির প্রয়াণে দুঃখিত। জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল, সত্য বলার জন্যই ভারতীয়রাজনীতিতে পরিচিত ছিলেন, খুব কমজনেরই সেই সাহস রয়েছে। কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে কথা বসেছিলেন, পুলওয়ামা হামলা নিয়ে কিছু অপ্রিয় সত্য তুলে ধরেছিলেন। এমন সাহসী মানুষ কুর্নিশ পাওয়ার যোগ্য। ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করি'।
লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গাঁধী লেখেন, 'প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের প্রয়াণের খবর অত্যন্ত দুঃখজনক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নির্ভীক থেকে সত্য বলে যাওয়া, মানুষের স্বার্থকে এক ব্যক্তি হিসেবে ওঁকে মনে রাখব আমি। ওঁর পরিবার, সমর্থক ও শুভাকাঙ্খীদের সমবেদনা জানাই'।