প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভারত ও বিশ্বের নানা দেশে স্কুল শিক্ষকরা কচিকাচাদের সামলাতে হিমশিম খান। বাচ্চারা ছুটোছুটি করে বেড়ায়। মনঃস্তত্ববিদরা স্কুলে বাচ্চাদের, বিশেষ করে ছেলেদের তুলনামূলক খারাপ পারফরম্যান্স ও প্রথামাফিক পড়াশোনায় ওদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ হারিয়ে ফেলার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, বাচ্চারা, বিশেষত ছেলেরা স্বভাবেই অশান্ত আর পুঁথিগত পড়াশোনা, ক্লাসরুমে বন্দি হয়ে থাকাটা অত্যাচার না হোক, অন্যায় তো বটেই। তবে এহেন পর্যবেক্ষণের যৌক্তিকতা, ভিত্তি যা-ই হোক, যা নিয়ে কোনও দ্বিমত, বিতর্ক হওয়ার কথা নয়, সেটা হল, স্কুলের বাচ্চাদের মনে একটা মন্ত্র গেঁথে দেওয়া হয়েছে, ‘চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক, নড়াচড়া কোরো না!’ কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধের উদ্দেশ্যেই বলে দাবি করে দুমাসের বেশি সময় আগে দেশব্যাপী ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে ভারত সরকারও সেই মন্ত্রই আপন করেছে।
নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের ৬ বছরের শাসনে ভারতে প্রায় প্রত্য়েকেই ওদের শিশুসুলভ ভাবনাচিন্তা, ছেলেমানুষির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছেন বলে মনে হয়। ওরা এমন এক শাসন চালাচ্ছে যা মর্জি, খামখেয়ালিপনার ওপর দাঁড়িয়ে, আশা করে, স্বেচ্ছাচারী ঢঙেই সরকার সবচেয়ে ভাল চলে, এটা সম্পূর্ণ মেনে নেবে সবাই। কেউ কটাক্ষ করতে পারেন, ভারতই শুধু লকডাউন চাপায়নি, কিন্তু দুনিয়াব্যাপী ঘটনাবলীর ওপর নজর রাখা প্রায় প্রত্যেক পর্যবেক্ষকই একমত হবেন যে, খুব কম দেশই, আদৌ থাকলেও বা, ভারতের মতো এমন দমনমূলক, কঠোর লকডাউন চাপিয়েছে। এটা প্রায় একটা ব্য়তিক্রম যে, ভারত যে লকডাউন চাপিয়েছে, তার আওতায় পড়েছে সারা দেশ এবং তা সর্বব্যাপী, এখন তার মেয়াদ দুমাসের ওপর গড়িয়েছে। আর এর অভিনবত্ব এটাই যে, মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে তা জারি করা হয়েছে।
এই ‘ফতোয়া দেওয়া শাসন’-এর স্ক্রিপ্ট লেখা হয়েছিল ২০১৬র নভেম্বরে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একদিন রাতে নোটবন্দি ঘোষণা করে জানিয়ে দিলেন, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট আর বৈধ মুদ্রা থাকছে না, যদিও নির্দিষ্ট কয়েক সপ্তাহ সময় দিলেন যাতে সেই নোট ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে নতুন নোট মেলে। তবে সেই নতুন নোটের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় খুবই কম ছিল। কালো টাকা বা সমান্তরাল ছায়া অর্থনীতি ধ্বংস, সন্ত্রাসবাদী ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের হাতে নগদ টাকার প্রবাহ বন্ধ করার ঘোষিত উদ্দেশ্য সামনে রেখে দেওয়া এই মাস্টারস্ট্রোক অবশ্য চরম বিপর্যয়, গন্ডগোল ডেকে আনে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক অর্থাত্ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২০১৮ সালে জানাল, বাতিল হওয়া ব্য়াঙ্কনোটের ৯৯.৩ শতাংশই ব্যাঙ্কিং সিস্টেমে জমা পড়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, অর্থনীতি ও সমাজ জীবনে এই পদক্ষেপের ফল হয় বিষময়। দিন আনি দিন খাই কোটি কোটি মানুষ, যারা নগদ অর্থনীতির ওপর বেঁচে থাকে, অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়েন।
আমরা হয়তো বলতে পারি যে, প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে চমক দিতে ভালবাসেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তিনি ও তাঁর উপদেষ্টারাই বোধহয় হতবাক হয়ে গিয়েছেন। ওঁদের কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে চান না, একমাত্র সেই ইতিহাসই পছন্দ করেন যা হিন্দু অতীতের গৌরবকে তুলে ধরে, যেহেতু তাঁর মন্ত্রিসভার কেউই মনে হয় না এটা অনুমান করেছেন যে, কোটি কোটি ভারতীয় ওনার ঘোষণা করা ‘চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক, নড়াচড়া কোরো না!’ মন্ত্র মেনে চলতে তৈরি নয়।
করোনাভাইরাস অতিমারী সারা বিশ্বে এমন সব ছবি তুলে ধরেছে, যা জীবিত মানুষের স্মৃতিতে দাগ কেটে যাবে চিরকালের মতো-বড় বড় নামডাকওয়ালা শহর ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, নিদ্রাহীন রাতের পর রাত কাটিয়ে কোনও নার্সের আইসিইউতে চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু, খাল-বিল-নদ-নদী আবার নির্মল, দূষণমুক্ত হয়েছে, আকাশে ফের চিল-শকুনের আনাগোনা। তবে এর থেকেও চেতনায় আরও ধাক্কা দেওয়া,কেউ বলতে পারেন, কষ্টদায়ক দৃশ্য দেখা গিয়েছে। দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ দলে দলে রাস্তায় নেমেছে ২৫ মার্চ মোদির প্রথম পর্যায়ের লকডাউন ঘোষণার পরপরই। সারা দেশ এক লহমায় থমকে গেল, কিন্তু অন্য অধিকাংশ দেশের তুলনায় ভারতে এই সিদ্ধান্তের তাত্পর্য্য অনেক অনেক বেশি। দেশের সব মেট্রোপলিটান শহর, এমনকী আয়তনে ছোট শহরগুলিতেও পরিষেবা দেয় একটু স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছাড়া নারী, পুরুষের কর্মিবাহিনী। পরিচারিকারা, কাজের লোকজন, যাদের আজও নির্দ্বিধায় চাকর-বাকর বলা হয়, হয়তো কোনও পশ আবাসনের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকে, কিন্তু ওদের একটা বিরাট অংশ রোজের আয়েই পেট চালায়। একই ব্যাপার ড্রাইভার, পাহারাদার, রাঁধুনি, পিওন, ডেলিভারি বয়, নির্মাণ শ্রমিক ও নানা ছুটকোছাটকা কাজ করা লোকজনেরও। কলকারাখানার কর্মী, নির্মাণশ্রমিকরা প্রায়ই কাজের জায়গাতেই ঘুমোয়। কলকারখানা লকডাউনের জেরে বন্ধ হওয়ার ফলে সঙ্গে সঙ্গে ওদের লাখ লাখের আশ্রয়টুকুও চলে গেল। ভারতের পরিযায়ী শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি। লকডাউন ওদের জীবনজীবিকাচ্যুত করল, সিংহভাগ আশ্রয়হীন হল। নানা সময়ে ভারতীয়া যা করেছে, ওরাও সেটাই করল-শহর থেকে পালিয়ে গ্রামের পথ ধরল।
মোহনদাস গাঁধী দেশের হৃদস্পন্দন বুঝতেন। অনেকে অবশ্য বয়স হয়ে যাওয়ায় তাঁকে ভারতের ‘আধুনিক’ জাতি-রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথে অন্তরায় বলে ভাবতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ভারত অর্ধেক বাস করে তার আধ মিলিয়ন গ্রামে। তিনি দারিদ্র-কবলিত, কুসংস্কার, পশ্চাত্পদ মানসিকতার আঁতুরঘর গ্রামের বন্দনা করতেন, এই কারণ দেখিয়ে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি হত বটে, কিন্তু গাঁধী যা বলতেন, সেটাই গত দুমাস ধরে পায়ে পায়ে নিজেদের গ্রামের পথ ধরা অগুনতি ভারতীয় সেটাকেই তুলে ধরেছেন। পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন কর্মী সুন্দরলাল বহুগুণার গারোয়াল পাহাড়ের আশ্রমে ৩৫ বছর আগে একবার গিয়েছিলাম। সেই স্মরণীয় সফরে উনি আমায় বলেছিলেন, ভারতের আত্মার বাস গ্রামে। গ্রাম মানে হৃদয়, যেখানে আত্মা বাস করে।
ভারত, বলতে গেলে গোটা পৃথিবীই মূল শিকড়ে অর্থাত গ্রামে ফেরার শত শত কাহিনির সাক্ষী হয়ে রইল। পরিযায়ী শ্রমিকরা প্রথমে বাস ডিপো, রেল স্টেশনে ভিড় করে, কিন্তু ভারত সরকার যাবতীয় গণপরিবহণ পরিষেবা বন্ধ রাখে। তাই ওদের সামনে হাঁটা ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা থাকল না। কেউ ৫০ কিমি, অনেকে ৫০০ কিমি, কখনও বা দিনে ৫০ কিমি হেঁটেছে, অধিকাংশ সময়ই খাবার-জল ছাড়াই। কারও পথেই মৃত্যু হয়েছে। বেশ কয়েকজন ট্রাকের তলায় পিষে গিয়ে মরেছে। ন্যানি সিনাত্রার কবিতার সেই লাইনগুলি মনে পড়ছে। তার মর্মবস্তু হল, এই যে বুটগুলো হাঁটার জন্য তৈরি হয়েছে, একদিন সেগুলো তোমাদের ওপর দিয়ে চলে যাবে! কিন্তু ভারতের পরিযায়ীদের বুট পরার মতো কপাল নেই। কারও কারও পায়ে চটি-চপ্পল অবশ্য ওঠে। কিন্তু এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ওরা চাপা পড়েছে। বিস্তারিত খুঁটিনাটি বেরচ্ছে যাতে এই দেশ, তার নেতাদের মাথা লজ্জায় হেঁট হওয়া উচিত। যেমন পরিযায়ীদের ওপর পোকামাকড় মারার মতো কীটনাশক স্প্রে করা হয়েছে।


ইতিহাসের পাতায় নজর রাখা পর্যবেক্ষকরা পরিযায়ীদের কাহিনির মধ্যে ১৯৪৭ এর ভারত বিভাজনের সময়কার বিপর্যয়ের ছায়া দেখা যাচ্ছে বলে ভাবলেন। তবে ভারতে অন্যায় রাষ্ট্রীয় পলিসি বা শাসকের অত্যাচারে অখুশি হয়ে দলবদ্ধ কায়দায় মানুষেরএক জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার ইতিহাস আছে। অনেক ইতিহাসবিদ বলেছেন, মুঘল যুগের ভারতে লোকে প্রায়ই অভিবাসনকে টিঁকে থাকার প্রাক-শর্ত বলেই মনে করত। ভারতে প্লেগের সঙ্গে অভিবাসনের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক আছে। ১৮৯৬ সালে ভারতে প্রথম দফার বিউবোনিক প্লেগের হামলার ধাক্কা প্রায় ১০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। বম্বের মারাত্মক ক্ষতি হয়, ১৮৯৭ এর জানুয়ারির মধ্যে সেখানকার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক গ্রাম-গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে সুরাতে নিউমোনিক প্লেগ ছড়ায়। ভারতে নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিনিধি জন এফ বার্নসের এক প্রতিবেদনের (২৪সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪) শিরোনাম ছিল-‘প্রাণঘাতী প্লেগের দৌরাত্ম্যে ভারতীয় শহর ছেড়ে পালাচ্ছে হাজারে হাজারে লোক’। কয়েক বছর বাদে ইতিহাসবিদ ফ্র্যাঙ্ক স্লোডেন তাঁর এক বইয়ে ‘শিল্প শহর সুরাত থেকে হাজারে হাজারে মানুষের প্রায় বাইবেলে বর্ণিত নিষ্ক্রমণে’র উল্লেখ করেন। কিন্তু ভারত রাষ্ট্র, সরকার এসবের কিছুই অনুমান করেনি, আর করে থাকলেও আমরা এটাই ধরে নিতে পারি যে, দেশের জনসংখ্য়ার একটা বড় অংশের যন্ত্রণা, দুর্ভোগকে ভারতীয়দের অনিবার্য বলে মেনে নিতে হবে। ব্যালটে নির্বাচিত সরকার ও মূলতঃ অশিক্ষিত রাজনীতিকদের ওপর ভরসা করার নানা পরিণতির একটা হয়তো এটা। এই রাজনীতিকরা দেশের নাগরিকদের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যেভাবে দেখে, সেভাবেই দেখেন। এঁরা স্বপ্নবিলাসী হয়ে ভাবেন, বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সাহায্য করছেন। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে পায়ে হাঁটা অন্য কথা বলে। স্বাধীনতার পরবর্তীতে সামাজিক পটচিত্রে প্রায় কিছুই বদলায়নি, যেমন গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে যাত্রা চলছেই, যা অন্তত ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত বাণিজ্যিক
হিন্দি ছবির প্রিয় থিম ছিল। অতিমারী-পরবর্তী পর্বে ভবিষ্যতের চেহারা কেমন হবে, তা সত্যিই কে বলতে পারে? পরিযায়ীদের ঘরে ফেরার স্রোত হয়তো দেশের ভাগ্য বদলে দেবে। দেশের আত্মা হয়তো জেগে উঠবে।

(বিনয় লাল লেখক, ব্লগার, সংস্কৃতি সমালোচক ও ইতিহাসের অধ্যাপক। লেখকের মতামত একান্তই ব্যক্তিগত)