কলকাতা: যে পরিবারে জন্ম, শৈশব পার, সে পরিবারের ছেলে বিপ্লবী, এ ভাবনা কোন্নগরের ঘোষ পরিবারে কস্মিনকালেও কেউ ভাবেনি। প্রখ্যাত চিকিৎসক কৃষ্ণধন ঘোষ, যিনি তৎকালীন সময়ে ডা. কে ডি ঘোষ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন, তিনি কখনই চাননি তাঁর পুত্রেরা কেউ 'সাধারণ ভারতীয়' হয়ে থেকে যাক, বরং সাহেবি আদবকায়দায় বেড়ে উঠুক তারা এই ছিল উদ্দেশ্য। ঈশ্বর হয়তো অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। বিপ্লব করেছিল অদৃষ্টই। দার্জিলিংয়ের লরেটো কনভেন্ট থেকে অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে পড়াশনো করা ছেলেই কি না হয়ে উঠলেন ইংরেজ বিরোধী। 


কৃষ্ণধন ঘোষ এবং স্বর্ণলতা দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র ছোট থেকেই 'অন্যরকম'। প্রথাগত বিষয় নয়, মাতামহ রাজনারায়ণ বসু, যিনি ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা তাঁর কাছ থেকেই সমাজসংস্কারের প্রাথমিক পাঠ পেয়েছিলেন অরবিন্দ। একসময় ইংরেজি ও নানাভাষা নিয়ে চর্চা করলেও সে-যুগের বিশিষ্ট সাহিত্যিক দীনেন্দ্রকুমার রায়ের কাছে বাংলা ভাষা শিখে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রেমে পড়েন। রামায়ণ-মহাভারত-গীতা কালিদাসও পড়েন। 


এরপর ধীরে ধীরে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। লোকমান্য তিলক এবং ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ হয়। লন্ডনে থাকার সময়েই অরবিন্দ গুপ্ত সমিতির সদস্য হয়েছিলেন। চিন্তা এবং চেতনায় তিনি চরমপন্থী মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের মতাদর্শে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। ‘আনন্দমঠ’-এর আদর্শ এবং উপন্যাস-বর্ণিত সন্ন্যাসীদের আত্মত্যাগের আদর্শ ও তাদের সংগ্রামের নিষ্ঠা ও সততা তাঁকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এর শুরু হল রাজদ্রোহ।       


১৯০৮ এর ৬ মে। আলিপুর বোমা মামলার প্রধান অভিযুক্তরূপে কারাবরণ করলেন অরবিন্দ ঘোষ। জীবন বদল সেখানেই। যেন এক অবিস্মরণীয় সন্ধিকাল। জেলে অত্যাচার-নিপীড়নের মাঝেই ঈশ্বর দর্শন চিন্তা করে যেতেন অরবিন্দ। নিজের কারাকাহিনী গ্রন্থে তা ব্যক্ত করে লিখেছেন, 'সর্বমঙ্গলময় শ্রীহরি যেন স্বয়ং গুরুরূপে সখারূপে সেই ক্ষুদ্র সাধনকুটীরে অবস্থান করিলেন। সেই আশ্রম ইংরাজের কারাগার।”


নিজের কারাবাসকে আশ্রমবাস করে তুলেছিলেন বিপ্লবী অরবিন্দ।  তিনি যেমন কৌতুক তাত্ত্বিক, তেমন ব্রহ্মচিন্তাময়ও ছিলেন। নিশ্চিন্তে ঈশ্বরচিন্তার সুযোগ তাঁকে দিত না কারারক্ষীরা। নিরাকার ব্রহ্মকে হৃদয়াসনে বসিয়ে অরবিন্দ লিখেছিলেন, অরবিন্দ জানাচ্ছেন, “এই সময় দুর্ব্বলচেতা নিজের দুর্ভাগ্য বা ভবিষ্যৎ জেলদুঃখ ভাবিয়া কাঁদে। ভগবদ্ভক্ত, নীরব রাত্রিতে ঈশ্বর-সান্নিধ্য অনুভব করিয়া প্রার্থনায় বা ধ্যানে আনন্দভোগ করেন।” 


নোংরা কারারক্ষ, দুর্গন্ধযুক্ত খাওয়া, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন এ সব প্রতিকূলতাকে তিনি কঠিন ব্রত হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। সব নেতিবাচকতাকে দূরে ঠেলে কারাকক্ষে বসেই মগ্ন হলেন গীতা-উপনিষদে। কারাগার আর তাঁর কাছে কারাগার রইল না, আপাত-অচেতন সমস্ত প্রতিবেশের মধ্যে তিনি উপলব্ধি করলেন সর্বব্যাপী চৈতন্যের উদ্ভাস, সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের অন্তরালে এক নির্বিকার নির্লিপ্ত শান্তিময় আনন্দস্বরূপ।


কারাবাস থেকেই যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পরবর্তী জীবনের তা বুঝতে পারা যায় অরবিন্দের লেখা থেকে। কারাকাহিনী বইয়ে তিনি লিখেছেন, “১৯০৮ সনের শুক্রবার ১লা মে ... জানিতাম না যে এই দিনই আমার জীবনের একটা অঙ্কের শেষ পাতা, আমার সম্মুখে এক বৎসরের কারাবাস, এই সময়ের জন্য মানুষের জীবনের সঙ্গে যতই বন্ধন ছিল, সবই ছিন্ন হইবে, এক বৎসর কাল মানবসমাজের বাহিরে পিঞ্জরাবদ্ধ পশুর মত থাকিতে হইবে। আবার যখন কৰ্ম্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিব, তথায় সেই পুরাতন পরিচিত অরবিন্দ ঘোষ প্রবেশ করিবে না.... বলিয়াছি এক বৎসর কারাবাস, বলা উচিত ছিল এক বৎসর বনবাস, এক বৎসর আশ্রমবাস। ... বৃটিশ গবর্ণমেন্টের কোপ-দৃষ্টির একমাত্র ফল, আমি ভগবানকে পাইলাম।”


পুরাণে বলে, কংসের কারাগারে বহুবর্ষ ধরে অজস্র দৈহিক ও মানসিক ক্লেশ সহ্য করার পর, দেবকী ও বসুদেব স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিতামাতা হওয়ার অতি-দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। কারা-ক্লেশ সহ্য করে নিজের যোগসাধনায় নিমজ্জিত ছিলেন অরবিন্দও— বিপ্লবী থেকে ঋষি হয়ে ওঠার পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজেকে।