পূর্ব মেদিনীপুর, নদিয়া ও হাওড়া: ৬ দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই। শেষমেশ আর পারলেন না। তমলুক জেলা হাসপাতালে মৃত্যু হল নন্দীগ্রামের গৃহবধূর।
পরপর দুই মেয়ের জন্ম দেওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে যাঁর গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে গোটা শরীরটা পুড়ে গিয়েছিল। অসহ্য যন্ত্রণায় দিনরাত শুধু ছটফট। এ ভাবেই প্রতি মুহূর্তে বাঁচা। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে বাঁচা। শেষমেশ থমকে গেল জীবন।
বছর সাতেক আগে নন্দীগ্রামের বনশ্রী গৌরী গ্রামের আব্দুল কালামের সঙ্গে বিয়ে হয় আনসুরার। অভিযোগ, গায়ের রং কালো হওয়ায় বিয়ের পর থেকেই বধূর উপর শুরু হয় অত্যাচার। এরপর, দুই মেয়ের জন্ম দেওয়ায় সেই অত্যাচার সীমা ছাড়ায়। অভিযোগ, বুধবার আনসুরার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
নিহতের বাপের বাড়ির অভিযোগ, আনসুরাকে হাত পা বেঁধে, মুখে কাঁপড় গুজে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। মৃত গৃহবধূর দিদার দাবি, মেয়ের গায়ের রং কালো, তাই অত্যাচার করত। দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হওয়ায় অত্যাচার আরও বেড়ে যায়। যারা আমার নাতনিকে এরকম পুড়িয়ে মারল তাদের শাস্তি চাই।
গত বুধবার আশঙ্কাজনক অবস্থায় তমলুক জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় গৃহবধূকে। সোমবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ঘটনার পর এতগুলি দিন কেটে গেলেও আজও অভিযুক্ত স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়িকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
মৃত গৃহবধূর কাকা বলেন, বুধবার হাত পা বেঁধে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। বুধবার ভর্তি করা হয়েছিল, সোমবার মারা যায়। কেন পুলিশ ধরছে না বুঝতে পারছি না।
পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের মতোই একই ঘটনা দেখল নদিয়ার শান্তিপুর। আবারও সেই গৃহবধূর উপর অকথ্য অত্যাচার! গৃহবধূর অপরাধ--- তিনি দ্বিতীয়বারও কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
শান্তিপুরের বাইপাস পাড়ার বাসিন্দা অসীমা পালের সঙ্গে বছর সাতেক আগে বিয়ে হয় কৃষ্ণনগরের বিশ্বজিৎ‍ পালের। তাঁদের বছর ছয়েকের এক কন্যা সন্তান রয়েছে। অভিযোগ, বছর দুয়েক আগে, দ্বিতীয় সন্তানও মেয়ে হওয়ায় গৃহবধূর উপর শুরু হয় অত্যাচার। দিন দিন যার মাত্রা বাড়ছিল। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, শেষমেশ বছর তেইশের অসীমা পালকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান তাঁর বাবা।
আক্রান্ত গৃহবধূর মা বলেন, দুই মেয়ের জন্ম দেওয়াতেই গণ্ডগোল। খালি মারত। তাই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। এরপর ঘটনা চরম আকার নেয় রবিবার রাতে। গৃহবধূর পরিবারের দাবি, সে দিন রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ তাঁদের বাড়িতে এসে স্বামী বিশ্বজিৎ‍ বলেন, অসীমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন। রাতে খাওয়াদাওয়াও করেন।
শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরেই গৃহবধূর মা-বাবা শুনতে পান, অসীমার বছর দুয়েকের মেয়ে তারস্বরে কাঁদছে। তাঁরা অসীমার ঘরের কাছে পৌঁছতেই দরজা খুলে ছুটে পালান বিশ্বজিৎ‍। ঘরে ঢুকে দেখা যায়, অসীমা রক্তাক্ত অবস্থায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। অভিযোগ, ইট দিয়ে মেরে তাঁর মুখ থেঁতলে দিয়েছেন স্বামী।
অভিযোগ, শান্তিপুরেই এক আত্মীয়র বাড়িতে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন অভিযুক্ত স্বামী। তাঁকে সেখান থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আক্রান্ত গৃহবধূকে প্রথমে শান্তিপুরের স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে কৃষ্ণনগর হাসপাতাল। সেখান থেকে কল্যাণী। অবস্থার অবনতি হওয়ায় শেষমেশ পাঠানো হয় কলকাতায়।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হাওড়াতেও। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে খবর, বছর দু’য়েক আগে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় হুগলির তারকেশ্বরের শ্রাবণীর।
অভিযোগ, বিয়ের পর পড়াশোনো চালিয়ে যেতে পারবে বলে স্ত্রীকে কথা দিলেও, বাস্তবে তা হতে দেননি স্বামী। এর সঙ্গে শুরু হয় পণের দাবিতে অত্যাচার। অভিযোগ, সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ার পরেও শ্রাবণীর প্রতি যত্ন নিতেন না শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। উল্টে তাঁকে দিয়ে বাড়ির কাজ করানো হত।
পরিস্থিতি চরমে ওঠে যমজ সন্তানের জন্মের পর। অভিযোগ, দুই মেয়ের জন্ম দেওয়ায় বধূর উপর অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়ে। অভিযোগকারী গৃহবধূ বলেন, বিয়ের পর থেকে অত্যাচার। প্রসূতি অবস্থায় বাড়ির কাজ করাত। মেয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ায় অত্যাচার বাড়ে।
স্বামীর অত্যাচারের মুখ রুখে দাঁড়ান গৃহবধূ। বলেন, থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাবেন। পাল্টা স্বামী তখন দুই মেয়েকে মেরে আত্মহত্যা করার হুমকি দেন বলে গৃহবধূর দাবি। তারপর, ফের স্ত্রীয়ের উপর অত্যাচার শুরু! শেষমেশ আর সহ্য করতে না পেরে দুই মেয়েকে কোলে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছাড়েন গৃহবধূ।
গৃহবধূর বাপের বাড়ির সদস্যদের দাবি, স্বামী-সহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনেদের বিরুদ্ধে তাঁরা চন্দননগর আদালতে গিয়ে অভিযোগ জানাবেন।
বিজ্ঞান বলে, সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে, তা মোটেই মায়ের উপর নির্ভর করে না। বিজ্ঞান যাই বলুক, বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলছে। বাস্তব দেখিয়ে দিচ্ছে, মেয়ে সন্তানের জন্ম দিলে আজও বউকে আগুনে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ ওঠে।