উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়, দক্ষিণ দিনাজপুর: করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেসামাল ভারত। দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে সাড়ে তিন লক্ষের গণ্ডি পেরিয়েছে।


লাগাতার ২ দিন ধরে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা তিন হাজার ছুঁইছুঁই। ভয়ঙ্কর এই অবস্থায় সংক্রমণকে বাগে আনার অন্যতম হাতিয়ার যে মাস্ক, চিকিৎসক থেকে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি, সকলেই বলছেন সে কথা।


কিন্তু সেই সতর্কবাণীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জায়গায় জায়গায় চলছে নিয়ম ভাঙার খেলা। মাস্ক পরা নিয়ে যখন এমন সব অজুহাত খাড়া করছেন কেউ কেউ, তখন অন্য ছবি দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুরে।


হরিরামপুরের এক অখ্যাত গ্রাম ছোটকড়ি। চাষবাস আর পশুপালনই এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা। গ্রামে ঘুরলেই স্পষ্ট দারিদ্রতার ছাপ। গ্রামে ঘুরতে ঘুরতেই দেখা গেল মাস্ক ছাড়াই অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। 


সেখানে অভাবের তাড়নায় মাস্ক পরার চেয়ে সেই টাকায় পেটের জ্বালা মেটানোকে প্রাধান্য দেন গ্রামবাসীরা। কোনও পরিবারে সাতজন, কোনও পরিবারের ৯ জন সদস্য। অথচ, মাস্কের সংখ্যা কোথাও ১ বা বড়জোর দুই। 


এমনই একটি পরিবারের সদস্য নবম শ্রেণির এক ছাত্রী জানাল, তারা চার বোন। বাড়িতে সদস্য সংখ্যা ৭। কিন্তু, তাদের মাস্ক মাত্র একটি।


ওই ছাত্রী বলেছে, কখনও দিদি পরে বেরোয়, কখনও আমি পরে বেরোই। যখন বেরোই দিদির মাস্ক পরে যাই, আমি ফিরলে দিদি ওটা পরে বেরোয়। আর দুজনকে একসঙ্গে বেরোতে হলে, একজন পরে, আরেকজন পরে না। 


 



 


কোনও বাড়িতে দুটো মাস্ক। সদস্য সংখ্য নজন। রোগ থেকে বাঁচতে সেখানেও পালা করে মাস্ক পরেন সদস্যরা। পরিবারের সদস্য ছাত্রী বললেন, দুটো মাস্ক স্কুল থেকে দিয়েছিল। দুটোই সম্বল। যে যখন বেরোই তখন এই মাস্কই পরে যাই। 


আরেকজন বাসিন্দা জানান, তাঁর বাড়িতেও একটিই মাস্ক রয়েছে। একাধিকবার ব্যবহার হয়েছে তা। এখন ধুয়ে রেখে দিয়েছেন। কোনও বিয়ে বা অনুষ্ঠানে গেলে তখন মুখে ওঠে মাস্ক। 


তাহলে কি কারও মনেই করোনার ভয় নেই? বারবার ব্যবহারে ফুটিফাটা হয়ে গেছে মাস্ক। কিন্তু, নতুন মাস্ক কেনার ক্ষমতা নেই, তাই বাধ্য হয়েই এটাই ব্যবহার করতে হয়। 


এক গৃহকর্তা বললেন, আমার ছোট্ট মুরগির ফার্ম, কোথা থেকে কিনব, মাস্ক কেনার পয়সা নেই, আমি জানি করোনা খুব ভয়ঙ্কর, কিন্তু মাস্ক কেনার ক্ষমতা নেই। 


শুধু একটি বাড়িই নয়। পাশের বাড়িতেও একই ছবি। সত্তর ছুঁইছুঁই বৃদ্ধর বক্তব্য, তিনি কখনও মাস্ক পরেননি। বললেন, পয়সা কোথায় যে মাস্ক কিনব!


তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধর পুত্রবধূর হাতে রয়েছে একটা মাস্ক। জানালেন, ভোট দেওয়ার পর পেয়েছেন। গ্রামের এক বাসিন্দা বললেন, কী করে মাস্ক কিনে দেব ছেলেমেয়েদের, সংসারই চলে না, কিনে দেওয়ার কোনও উপায় নেই। 


গ্রামেরই আরেক বাসিন্দার দাবি, তাঁর বাড়িতেও একটা মাস্ক আছে। সেটা দিয়েই বাকি পাঁচজনের চলে যায়। 


গ্রামের রাস্তায় আরও অনেককেই মাস্ক ছাড়াই ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল। প্রত্যেকেরই দাবি, পয়সার অভাবেই মাস্ক কিনতে পারছেন না তাঁরা। 


একজনের মাস্ক আরেকজনের ব্যবহার করা উচিত নয়। ভাগাভাগি করে মাস্ক পরলে, উপকারের বদলে ক্ষতিই হয়। 


তবুও অনেক জায়গায় যেখানে মাস্ক পরায় অনীহা, সেখানে ছোটকড়ি গ্রামে স্রেফ আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায়, একটা মাস্ক অনেকে ভাগাভাগি করছেন।