নয়াদিল্লি: ছবির মতো সাজানো গোছানো দেশ। সেই টানেই বার বার ছুটে যান মানুষ। কিন্তু এশিয়ার অন্যতম পর্যটনস্থল হিসেবে চিহ্নিত দুই দেশ, তাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়া এই মুহূর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘাত এত তীব্র হয়েছে যে গোলাগুলি, এমনকি রকেট বর্ষণ চলছে। দশকের পর দশক ধরেই সীমান্ত সংঘাত চলে আসছে দুই দেশের মধ্যে, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র ১০০০ বছর পুরনো একটি শিবমন্দির। (Thailand-Cambodia Conflict)

গত কয়েক দিন ধরেই তাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়ার মধ্যে পরিস্থিতি তেতে উঠছিল। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তা চরম আকার ধারণ করে গোলাগুলি বর্ষণের পাশাপাশি, রকেট পর্যন্ত ছোড়া হয়। সেনাশিবির লক্ষ্য করে চলে এয়ার স্ট্রাইক। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপের দাবি উঠছে। তবে এই সীমান্ত সংঘাতের নেপথ্য়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে দুই দেশের সীমান্তে অবস্থিত মন্দিরগুলিও। (Thailand-Cambodia Border Dispute)

সীমান্তে ল্যান্ডমাইন পেতে রেখা হয়েছে বলে সম্প্রতি কম্বোডিয়ার দিকে আঙুল তোলে তাইল্যান্ড। তাদের এক সৈনিকের পা উড়ে গিয়েছে, আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানানো হয়। সেই আবহেই বুধবার দাংরেক পার্বত্য সীমান্তে, ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীন মন্দিরের উপর কম্বোডিয়ার ড্রোন ঘুরছিল বলে অভিযোগ করে তাইল্যান্ড। এর পরই গোলাগুলি, ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ শুরু হয়। F-16 যুদ্ধবিমান থেকে এয়ারস্ট্রাইকও চলে। (Prasat Ta Muen Thom Temple)

ফরাসি শাসকের হাতেই যে সীমান্তরেখা তৈরি হয়, তা নিয়ে দশকের পর দশক রক্তাক্ত হয়েছে তাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। সেই সংঘাত জটিলতর হয়ে উঠেছে একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরকে ঘিরে। দাংরেক সীমান্তে তিনটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির রয়েছে, Ta Muen Thom, Ta Muen এবং Ta Muen Toch. সেগুলি ১১ শতক থেকে সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। এই মুহূর্তে যে মন্দিরটিকে ঘিরে সংঘাত চরমে উঠেছে, সেটির নাম হল প্রসাত তা মুয়েন থম (Prasat Ta Muen Thom). সেটি একটি খেমার-হিন্দু মন্দির।  

এই প্রসাত তা মুয়েন থম মন্দিরটি ‘দ্য গ্রেট টেম্বল অফ দ্য গ্র্যান্ডফাদার চিকেন’ও বলা হয়। ১১ শতকে রাজা দ্বিতীয় উদয়াদিত্যবর্মন মন্দিরটির নির্মাণ করেন। মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয় ভগবান শিবকে। দাংরেক পার্বত্যঅঞ্চলের উপর দিয়েই প্রাচীন খেমার হাইওয়ে গিয়েছে, যা কম্বোডিয়ার আঙ্কোর এবং তাইল্যান্ডের ফিমেইকে সংযুক্ত করে। যাত্রাপথে পর পর ওই মন্দিরেই বিশ্রাম নিতেন পথিকরা।

তাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া, দুই দেশই ওই মন্দিরের উপর নিজেদের অধিকার দাবি করে দুই দেশই। তাইল্যান্ডের সুরিন এবং কম্বোডিয়ার ওদ্দার মেয়াঞ্চির মধ্যবর্তী যে জায়গায় অবস্থিত মন্দিরটি, সেটি নিয়েও দ্বন্দ্ব আজকের নয়। খেমার সাম্রাজ্যের সীমান্ত অনুযায়ী, ওই মন্দিরকে নিজেদের বলে দাবি করে কম্বোডিয়া।  তাইল্যান্ড মন্দিরটিকে নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি করে।

প্রসাত তা মুয়েন থম মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা পাথরের একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। খেমার সাম্রাজ্যের মন্দিরগুলি সাধারণত পূর্বমুখী হয়। তবে এই মন্দিরের মূল প্রবেশপথ দক্ষিণে। বৃহত্তম যে স্তম্ভটি রয়েছে, সেটি থেকে যে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে, সেটি কম্বোডিয়া অভিমুখে। মন্দিরের দেওয়ালে সূক্ষ্ম খোদাইকার্য চোখে পড়ে। হিন্দু দেবদেবীদের চেহারা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাতে। গুপ্তসাম্রাজ্য পরবর্তী ভারতীয় শিল্পের ছোঁয়া রয়েছে, যা খেমার সাম্রাজ্যের সঙ্গে ভারতের গুপ্ত বংশের সংযোগ প্রমাণ করে।

মন্দিরের নকশায় ভারতীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া থাকা নিয়ে ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন, ব্যবসাবাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক আদানপ্রানের দরুণই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। খেমার সাম্রাজ্যও শৈব ও বৈষ্ণব দর্শনকে গ্রহণ করে। বিশেষ করে দক্ষিণের পল্লব বংশের হাত ধরে এশিয়ার অন্য দেশগুলিতে ভারতীয় সংস্কৃতি পৌঁছে যায়। 

প্রসাত তা মুয়েন থম মন্দির চত্বরে দু’টি ছোট মন্দিরও রয়েছে, প্রসাত তা মুয়েন তচ এবং প্রসাত তা মুয়েন। খেমার সাম্রাজ্য পরবর্তীতে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। মন্দিরটিতেও বৌদ্ধদের আনাগোনা শুরু হয় সেই মতো। ৯-১৫ শতকের মধ্যে সেগুলির নির্মাণ হয়। মন্দিরটি সংরক্ষণ করা হলেও, তা অক্ষত নেই। প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই মন্দির ফের আলোচনায় উঠে এসেছে সংঘাতের জেরে।