নয়াদিল্লি: বন্দেভারত, নমোভারত এবং সর্বোপরি বুলেট ট্রেন নিয়ে মাতামাতি হলেও, সাধারণ রেল পরিষেবায় অনেক গলদ রয়ে যাচ্ছে বলে আগাগোড়া সতর্কবার্তা উঠে এসেছে। পৃথক রেল বাজেট তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও কম সমালোচনা হয়নি। সাম্প্রতিক কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় আবারও সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ ২০১৪ সাল থেকে, গত ১০ বছরে একের পর এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ভারত। (Train Accidents in Recent Times)
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ১০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন প্রায় ৬০ জন। জানা গিয়েছে, পিছন দিক থেকে একটি মালগাড়ি এসে ধাক্কা মারে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে, যার ফলে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনের তিনটি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে যায়। ঠিক কী কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটল, তা এখনও জানা যায়নি। তবে এই প্রথম নয়, গত ১০ বছরে একের পর এক এমন ভয়ঙ্কর ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। (Train Accidents in 10 Years)
গোরক্ষধাম এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা, ২০১৪: ২০১৪ সালের ২৬ মে উত্তরপ্রদেশের হিসার-গোরক্ষপুর রুট ধরে ছুটে যাচ্ছিল গোরক্ষধাম এক্সপ্রেস। সেই সময় ট্রেনের ১১টি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে যায়। তদানীন্তন রেল প্রতিমন্ত্রী মনোজ সিনহা সংসদে জানান, ডাবল লাইন দিয়ে সেকশন ধরে এগনোর সময় ট্রেনটি বাঁ দিকের লাইনে উঠে যায়। সেই সময় চুরেব স্টেশনে একটি মালগাড়ি দাঁড়িয়েছিল। সোজা ওই মালগাড়িতে ধাক্কা মারে ট্রেনটি। 'Tongue Rail'-এ সমস্যা থাকার দরুণই দুর্ঘটনাটি ঘটে বলে জানানো হয় সেই সময়। ওই দুর্ঘটনায় ২৯ জন মারা যান। আহতত হন ৭০ জনের বেশি।
জনতা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা, ২০১৫: ২০১৫ সালের ২০ মার্চ দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয় বারাণসী-দেহরাদূণ জনতা এক্সপ্রেস। উত্তরপ্রদেশের স্টেশনে দাঁড়ানোর কথা থাকলেও, ট্রেনটি দাঁড়ায়নি। কিছুদূর ছুটে গিয়ে একটি বালির ঢিবিতে ধাক্কা মারে ট্রেনটি। ইঞ্জিন এবং দু'টি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে যায়। সেবার দুর্ঘটনায় ৩৯ জন মারা যান। আহত হন প্রায় ১৫০। ব্রেক ফেল করাতেই দুর্ঘটনা ঘটে বলে তদন্তে উঠে আসে পরবর্তীতে। এই দুর্ঘটনার পর ব্রেক পাওয়ার সার্টিফিকেট, নিয়মিত ব্রেক পরীক্ষার সুপারিশ করা হয়।
ইন্দোর-পটনা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা ২০১৬: ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর ইন্দোর-পাটনা এক্সপ্রেসের ১৪টি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে যায় কানপুরে। ওই দুর্ঘটনায় ১৫২ জন মারা যান। দুর্ঘটনার নেপথ্য়ে নাশকতা যোগ রয়েছে বলে সেই সময় দাবি করা হয়, তার দরুণ শুরু হয় NIA তদন্তও। প্রকাশ্য জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ওই দুর্ঘটনাকে 'ষড়যন্ত্র' বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু ২০২০ সালে তদন্তের যে রিপোর্ট সামনে আসে, তাতে দেখা যায়, যান্ত্রিক গোলযোগের জেরেই দুর্ঘটনা ঘটে। একটি কামরার ওয়েল্ডিংয়ে জং পড়ে গিয়েছিল। সেটিই প্রথমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তার দরুণ দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়।
হীরাখণ্ড এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা, ২০১৭: ২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি অন্ধ্রপ্রদেশে লাইনচ্যুত হয় জগদলপুর-ভুবনেশ্বর হীরাখণ্ড এক্সপ্রেস। ওই দুর্ঘটনায় ৪০ জন প্রাণ হারান। আহত হন ৫০ জন। CID-র পাশাপাশি, NIA-ও তদন্তে নামে। গোড়ায় মাওবাদী যোগ রয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হলেও, আজও সেই দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট সামনে আসেনি।
জলন্ধর-অমৃতসর DMU, অমৃতসর-হাওড়া এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা, ২০১৮: অমৃতসর স্টেশনের কাছে রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকে প্রায় ৬০ জনকে চাপা দেয় দু'টি ট্রেন। ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর এই দুর্ঘটনা ঘটে। দশেরা উদযাপন করতে রেললাইনের উপর প্রায় ৩০০ মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। রেললাইনে দাঁড়িয়ে আতসবাজির খেলা দেখছিলেন তাঁরা। একটি লাইনে জলন্ধর-অমৃতসর DMU ট্রেনটি ঢুকে পড়ে। তাতে মানুষজন আর একটি লাইনে সরে গেলে সেখানে অমৃতসর-হাওড়া এক্সপ্রেস এসে পড়ে। তদন্তে একাধিক গলদের কথা উঠে এলেও, রেলের তরফে ওই ঘটনাকে ট্রেন দুর্ঘটনা হলে মানতে চাওয়া হয়নি। তাদের দাবি ছিল, মানুষজনই বেআইনি ভাবে লাইনের উপর দাঁড়িয়েছিলেন। সংসদেও সেই মর্মেই বিবৃতি দেন তদানীন্তন রেল প্রতিমন্ত্রী।
সীমাচল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা, ২০১৯: দিল্লি অভিমুখে ছুটে চলা সীমাচল এক্সপ্রেস বিহারের বৈশালীতে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি লাইনচ্যুত হয়। ট্রেনের ন'টি কামরা লাইনচ্যুত হলে সাত জন মারা যান। আহত হন বহু। রেললাইনে ফাটলের দরুণই দুর্ঘটনা ঘটে বলে তদন্তে উঠে আসে।
ঔরঙ্গাবাদ মালগাড়ি দুর্ঘটনা, ২০২০: করোনাকালে সবে লকডাউন ঘোষণা হয়েছে সেই সময়। ২০২০ সালের ৮ মে হায়দরাবাদের কাছে ১৬ জন পরিযায়ী শ্রমিককে চাপা দেয় একটি মালগাড়ি। হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় ওই লাইনে জিরিয়ে নিতে বসেছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। ট্রেন, বাস সব বন্ধ জেনে ক্লান্তি দূর করতে লাইনের উপরই শুয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ঘুম আর ভাঙেনি। রেললাইনের উপর মানুষজনকে শুয়ে থাকতে দেখেও মালগাড়ির চালক ট্রেন থামাতে পারেননি বলে জানা যায়। মানবিকতার খাতিরে সেবার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও, রেল দুর্ঘটনার দায় নিতে অস্বীকার করে। রেললাইনে বেআইনি ভাবে ওই পরিযায়ী শ্রমিকরা রেললাইনের উপর শুয়েছিলেন বলে জানানো হয়।
বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা, ২০২২: ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে লাইনচ্যুত হয় বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস। সেবারও যান্ত্রিক গোলযোগকে দায়ী করা হয় দুর্ঘটনার জন্য। এই দুর্ঘটনায় ১০ জন মারা যান। আহত হন প্রায় ৪০ যাত্রী। ট্রেনের ১২টি কামরা লাইনচ্যুত হয়।
শালিমার-চেন্নাই করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা, মালগাড়ি ও বেঙালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা ২০২৩: ২০২৩ সালের ২ জুন তিনটি ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সব মিলিয়ে ২৯৩ জন মারা যান। ওড়িশার বালেশ্বরে এই দুর্ঘটনা ঘটে। লুপলাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়িতে প্রথমে ধাক্কা মারে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ট্রেনের কয়েকটি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে পাশের লাইনে গিয়ে পড়ে। সেই সময় হাওড়ামুখী বেঙালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস সেখানে এসে পড়ে। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত কামরায় ধাক্কা মারে। এই ঘটনায় সাত রেলকর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়। তদন্তে নেমে তিন জনকে গ্রেফতারও করে CBI. কর্তব্যরত অবস্থায় কাজে গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। সিগনালের সমস্যাও ধরা পড়ে।