নয়াদিল্লি: গত সাত মাসে আটটি মৃত্যুর ঘটনা। আরও দু'টি মৃত্যুর ঘটনাও সন্দেহের ঘেরাটোপে। গুরুতর জখম হয়েছেন কমপক্ষে ৩৪ জন। উত্তরপ্রদেশে নেকড়ের হামলাকেই এতগুলি ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। ঘাতক নেকড়ের দলের খোঁজে চলছে চিরুনি তল্লাশিও। কিন্তু হঠাৎ কেন ঘাতকের রূপ নিল নেকড়ের দল? হঠাৎ কেন এত মানুষকে কামড়ে চলেছে তারা? প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে উঠে আসছে একাধিক তত্ত্ব। (Wolf Attacks in Uttar Pradesh)


উত্তরপ্রদেশের বাহরাইচে নেকড়ের আক্রমণে আট জনের মৃত্যু হয়েছে এখনও পর্যন্ত। মৃতদের মধ্যে সাতজনই শিশু। এখনও পর্যন্ত হামলাকারী সন্দেহে চারটি নেকড়েকে আটক করতে পেরেছে বন দফতর। আরও দুই নেকড়ে লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের খোঁজেও তল্লাশি অভিযান শুরু হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ ফরেস্ট কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার সঞ্জয় পাঠকের মতে, প্রতিশোধের বশবর্তী হয়েই পর পর এমন হামলা হয়ে থাকতে পারে। (UP Wolf Attacks)


এমনিতে নিরীহ, শান্ত স্বভাবের জন্যই পরিচিত নেকড়ে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে তাদের যে রূপ দেখে গিয়েছে, বিশেষ করে শিশুদের উপর যেভাবে হামলা করেছে তারা, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে ধন্দে পড়ে গিয়েছেন পশু বিশেষজ্ঞরাও। তবে সঞ্জয়ের মতে, তাদের বাসা বা সন্তানের ক্ষতি হলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে নেকড়েরা। প্রতিশোধ নিতে ছুটে যায়। এক্ষেত্রেও তেমনটি হয়ে থাকতে পারে। 


এর সপক্ষে একাধিক যুক্তিও উঠে আসছে। বাহরাইচের রামুয়াপুরের গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, গ্রামের অদূরে, আখের জমিতে গর্তের মধ্যে নেকড়ে শাবকের দেখা মিলেছিল। কিন্তু ভারী বৃষ্টির জেরে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়। ঘাগড়ার জল ঢুকে যায় ছ'ফুটের ওই গর্তে। গ্রামবাসীদের আশঙ্কা, নদীর জল ঢুকে নেকড়ে শাবকগুলি মারা গিয়ে থাকবে। মানুষের জন্যই এমন ঘটেছে ভেবে, সন্তানদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই হয়ত শিকারি হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে নেকড়েগুলি। 


বন্যার পর আশ্রয় চলে যাওয়াতেও নেকড়েগুলি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে বলেও মত অনেকের। সেই কারণেই তারা লোকালয়ের দিকে এগিয়ে এসেছে এবং যাকে সামনে পেয়েছে, কামড়ে ধরেছে বলে দাবি করছেন তাঁরা। এই প্রথম নয় যদিও, এর আগেও, ১৯৯৬ সালে প্রতাপগড়ে নেকড়ের আক্রমণের শিকার হয় ১০ শিশু। পরে জানা যায়, নেকড়ের শাবক দেখে তাদের গর্ত ভেঙে দেন কিছু কৃষক। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এবারও। 


নেকড়ের দলকে ধরতে ইতিমধ্যে ১০ সদস্যের দল গড়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকার। রাজ্যের বনমন্ত্রী অরুণ সাক্সেনা জানিয়েছেন, নেকড়ের দলের নাগাল পেতে চরম তৎপর রাজ্য সরকার। দুই রেঞ্জারও তল্লাশিতে যোগ দিয়েছেন। নেকড়েগুলিকে অজ্ঞান করার দায়িত্ব তাঁদেরই। অজ্ঞান না করতে পারলে, গুলি করে মেরে ফেলার নির্দেশ রয়েছে। তবে জীবিত অবস্থায় নেকড়েগুলিকে ধরতেই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।


সচরাচর এমন কিছু না ঘটলেও, নেকড়েরা মোটেই শান্ত, নিরীহ নয় বলে পাল্টা দাবিও উঠে আসতে শুরু করেছে। 'মহাভারতে' ভীমকে 'বৃকোদর' বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর প্রবল ক্ষুধা এবং শক্তির জন্য। ইংরেজিতে 'নেকড়ের মতো ক্ষুধার্ত' কথার প্রচলন রয়েছে। ইংরেজ আমলের রেকর্ডেও ভারতে নেকড়ের আক্রমণের উল্লেখ মেলে। বঙ্গ বাহিনীর ক্যাপ্টেন বি রজার্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলার উপকূল অঞ্চলে ১৮৬৬ সালে নেকড়ের আক্রমণে ৪ হাজার ২৮৭ এবং বাঘের আক্রমণে ৪ হাজার ২১৮ জন মারা যান। উত্তর-পশ্চিমের অঞ্চল এবং অওধে ১৮৭১ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত ১ লক্ষ নেকড়ে হত্যার রেকর্ডও মেলে।


উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং বাংলায় বারংবার নেকড়ের আক্রমণের উল্লেখ মেলে। ১৯৮৫-'৮৬ সালে মধ্যপ্রদেশের আস্থায় নেকড়ের হামলায় ১৭ শিশু মারা যায়। প্রথমে একটি নেকড়ে হামলা চালায় বলে ধরা হলেও, পরে দেখা যায়, চারটি নেকড়ে মিলে হামলা চালায়। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে হঠাৎই শিশুচুরি হচ্ছে বলে হইহই পড়ে যায় হাজারিবাগে। পরে দেখা যায়, নেকড়ের হামলায় হাজারিবাগ ওয়েস্ট, কোডারমা এবং লাটেহারে নেকড়ের হামলায় ৬০ শিশু মারা গিয়েছে। আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে যায় ২০ শিশু।


১৯৯৬ সালে গবেষক ওয়াই ভি ঝালা এবং ডি কে শর্মা উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়, সুলতানপুর এবং জৌনপুরে শিশুদের উপর ৭৬টি নেকড়ে হামলা নিয়ে গবেষণা করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, দলবল মিলে নয়, একটি পুরুষ নেকড়ে এবং তা অনুগামীরাই হামলার জন্য দায়ী। জঙ্গলে শিকারের সংখ্যা কমে যাওয়াতেই লোকালয়ে ঢুকে শিশুদের উপর তারা হামলা চালায় বলে উঠে আসে ওই গবেষণায়। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অগাস্ট মাসে বাহরাইচ সংলগ্ন বলরামপুর থেকেও নেকড়ে হামলার ঘটনা সামনে আসে। ১০টি শিশুর মৃত্যু হয় সেবার।