নয়াদিল্লি: ছিলেন 'কিং অফ গুড টাইমস'। হয়ে গিয়েছেন, 'পলাতক ঋণখেলাপি'। এতদিন কিছু না বললেও, এবার মুখ খুললেন কিংফিশার কর্তা বিজয় মাল্য। নিজেকে রাজনীতির শিকার বলে দাবি করলেন তিনি। জানালেন, তিনি ব্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলান, মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁকে ঋণখেলাপি বলা সঙ্গত নয়। পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা CBI এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেটের (ED) ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুললেন। (Vijay Mallya)
ইউটিউবার রাজ শামানির পডকাস্টে খোলাখুলি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মাল্য। আর সেখানেই একের পর এক চাঞ্চল্যকর দাবি করেছেন। মাল্য জানিয়েছেন, ২০১৬ সালে দেশ ছাড়ার আগে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে সংসদে দেখা করেন তিনি। বিদেশ যাচ্ছেন বলে জানানোর পরই বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেন। ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান, মীমাংসা করতে চান বলেও জেটলিকে জানান তিনি। কিন্তু তাঁর দেশে ফেরার রাস্তাই বন্ধ হয়ে যায়। (Kingfisher Case)
দেশছাড়ার প্রসঙ্গে মাল্য বলেন, "১৯৮৮ সাল থেকে ইংল্যান্ডে ছিলাম আমি। ইংল্যান্ডের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলাম দীর্ঘ ৩২ বছর। কিন্তু প্রবাসী ভারতীয় স্বীকৃতি ছাড়িনি। আমি সাংসদ ছিলাম, তাই ভারতীয় পাসপোর্ট রেখেছিলাম। আমি অর্থমন্ত্রীকে বলে, সাধারণ বিমানে চেপে বিমানবন্দরে যাই। তাসত্ত্বেও তামাশা শুরু হয়ে গেল। এমন ক্ষেত্রে সরকার সাধারণত তথ্য যাচাই করে। আমি বিদেশে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, যদি শেয়ার বিক্রি করা নিয়ে। ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে মীমাংসা করতে চাইছিলাম। ED-কে চিঠি দিয়ে জানাই, সময় দিন। আমি শেয়ার বিক্রির কথা বলছি। CBI-এর কাছে গিয়েছি, আপনাদের কাছেও যাব। কিন্তু আমার পাসপোর্টই বাতিল করে দেওয়া হল। পাসপোর্ট ছাড়া কোথায় যাব? কী করে যাব? "
এখন তাঁকে দেশে ফেরাতে যে তৎপরতার কথা শোনা যায়, তাকে 'লোক দেখানো' বলে উল্লেখ করেছেন মাল্য। তাঁর কথায়, "সরকারের তরফে কেউ বলেছেন আমি কী অপরাধ করেছি? মনগড়া কাহিনি শোনালে তো হবে না, প্রমাণ দিতে হবে। আমি কি তছরুপ করেছি? মাদক পাচার করেছি? হিংসা ঘটিয়েছি? আমি প্রতারণা করিনি। ইচ্ছাকৃত ভাবে ঋণখেলাপ তখন বলা যায়, যদি কেউ টাকা থাকা সত্ত্বেও ধার শোধ না করে। আমি তো মীমাংসা করতে চেয়েছিলাম! আমার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। সেই সম্পত্তি থেকেই ১৪১০০ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে কাউকে চোর বলা যায় না।"
মাল্য জানিয়েছেন স্টেটমেন্ট চেয়ে ব্যাঙ্কগুলির কাছে বার বার আবেদন করেন তিনি। কমপক্ষে ১৫ বার স্টেটমেন্ট চেয়ে পাঠান। কিন্তু কোনও সাড়া মেলেনি। এর পর সংসদে অর্থমন্ত্রীর ভাষণ থেকে জানতে পারেন, তাঁর সম্পত্তি বিক্রি করে ১৪ হাজার ১৩১ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। আর তাতেই মারাত্মক দাবি তুলেছেন মাল্য। তাঁর কথায়, "৯০০০ কোটি টাকার ঋণ নেননি তিনি। কোথা থেকে ওই সংখ্যা এল জানি না। সুদ সমেত আসল সংখ্যা হল ৬ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। সুপ্রিম কোর্টেও সেই রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তাঁর সম্পত্তি বিক্রি করে ১৪ হাজার ১৩১ কোটি টাকা তুলেছে কেন্দ্র। অর্থাৎ আড়াই গুণ বেশি টাকা তোলা হয়েছে। তার পরও চোর, পলাতক বলা হচ্ছে। হায়দরাবাদে SBI-এর চেয়ারম্যানের সঙ্গেও দেখা করি আমি। একবারও বলিনি ঋণ শোধ করব না। কিন্তু ওরা হয়ত ১৪ হাজার ১০০ কোটি টাকাই তুলতে চেয়েছিলেন। তাই আমার মীমাংসা প্রস্তাবে রাজি হননি। কারণ আমার প্রস্তাব গ্রহণ করলে ৫০০০ কোটি টাকাই জুটত। ডেট রিকভারি ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে, ঋণ ছিল ৬২০৩ কোটি ৩৫ লক্ষ ৩ হাজার ৮৭৯ টাকা ৪২ পয়সা। তাহলে ৯ হাজারের গল্প এল কোথা থেকে?"
কিন্তু বেছে বেছে তাঁকেই বা নিশানা করা হল কেন? মাল্যর জবাব, "গুরুত্বহীন কেউ কি পোস্টার বয় হতে পারে? উদাহরণ তৈরি করতে চাইলে কাকে নিয়ে করবেন? ১৫ বার মনে করানোর পরও ব্য়াঙ্ক স্টেটমেন্ট দেয় না কখনও শুনেছেন? পৃথিবীর কোথাও এমন হয় না। আমি সংসদে অর্থমন্ত্রীর ভাষণ থেকে ১৪ হাজার ১০০ কোটির কথা জানলাম। আমার বিরুদ্ধে একটা ভাষ্য তৈরি করা হয়েছে। আমি সরকারের কথাই বলব, যার মধ্যেই পড়ে CBI এবং ED. আমি ওদের পোস্টার হয়। আমি রাজনীতির ফুটবল। বিজেপি বলছে, কংগ্রেস ঋণ দিয়েছে। কংগ্রেস বলছে, BJP পালিয়ে যেতে দিয়েছে। আমি মাঝখানে ফুটবল হয়ে রয়েছি। আসলে ভারতে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হল সরকার। এটা DNA-তে রয়েছে। কেন্দ্র বা রাজ্য যা-ই বলুক না কেন, ভারতে ব্যবসা করা মোটেই সহজ নয়। আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক বাধা-বিপত্তি রয়েছে। ব্য়বসা মানেই ঝুঁকি। কিন্তু ভারতে ব্যবসা যদি সফল না হয়, সটান জালিয়াত, প্রতারক তকমা সেঁটে দেওয়া হয় গায়ে। আর কোনও দেশে এমন হয় না। নির্বাচন এলেই ভারতের বাইরে চলে যেতাম। চাইতাম না কেউ যোগাযোগ করতে পারুক। রাজনীতিকরা টাকা আদায়ের ফন্দি করত।" নির্বাচনের সময় রাজনীতিকরা টাকা, গাড়ি, মদ চাইতেন বলেও দাবি করেন মাল্য।
মাল্য জানিয়েছেন ১০১২ থেকে ১০১৫ সাল পর্যন্ত বার বার ব্যাঙ্কগুলিকে সেটলমেন্টের প্রস্তাব দেন তিনি। দেশ ছাড়ার পরও বার বার সময় চেয়েছেন। কিন্তু কারও তরফে কোনও সাড়া মেলেনি। মাল্য বলেন, "SBI-এর এক সিনিয়র অফিসার আমার এক বন্ধুকে বলেছেন, 'আমি হলে বিজয় মাল্যর সঙ্গে সেটল করে নিতাম। কিন্তু পর দিনই CBI এসে হাজির হতো'।" কিন্তু CBI বা ED তাঁর সঙ্গেই এমন আচরণ করছে কেন? মাল্যর জবাব, "CBI-কে কি খাঁচাবন্দি তোতা বলা হয় না?" ভারতে কি কখনও আর ফিরবেন মাল্য? তাঁর যুক্তি, যদি নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাস পান, ন্যায্য বিচারের আশ্বাস পান, যদি আগের মতো সম্মানের সঙ্গে বাঁচার সুযোগ পান, তবেই ফিরবেন তিনি। মাল্য জানিয়েছেন, সংবাদমাধ্যমের সামনে কান্নাকাটি করলে হয়ত সমবেদনা কুড়োবেন তিনি। কিন্তু তিনি এসব করবেন না। নিজের মতো করেই লড়াই চালিয়ে যাবেন। মাল্যর দাবি, সরকার, সংবাদমাধ্যম তাঁকে কয়েদির পোশাকে দেখতে চায়। তিনি যে কোনও পরিস্থিতির জন্যই প্রস্তুত রেখেছেন নিজেকে।