নয়াদিল্লি: ওয়াকফ  সংশোধনী বিল নিয়ে উত্তাল দেশের সংসদ। একদিকে, পূর্বতন UPA সরকারকে তীব্র আক্রমণ নরেন্দ্র মোদি সরকারের, অন্য দিকে, কেন্দ্রকে তুলোধনা বিরোধীদের। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কিরেণ রিজিজুর দাবি, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার না গঠিত হলে, দেশের সংসদভবনটিও ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হতো। অন্য দিকে, বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের সম্পত্তির অধিকার ছিনিয়ে নিতেই সরকার তৎপর বলে অভিযোগ করছেন বিরোধী শিবির I.N.D.I.A. (Waqf Amendment Bill)


বুধবার লোকসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিল পেশ করেন রিজিজু। সেখানে পূর্বতন UPA সরকারকে লাগাতার আক্রমণ করে যান রিজিজু। ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরোধিতা করছেন যাঁরা, তাঁদের মুসলিম বিরোধী হিসেবে গণ্য করা হবে বলে দাবি করেন তিনি। দক্ষিণের রাজ্যগুলিকেও সতর্ক করেন রিজিজু। বিল পাস না হলে আগামী আরও মন্দির, আরও গির্জার সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাবে বলে দাবি করেন। এর পাল্টা বক্তৃতায় বিজেপি-কে বেঁধেন কংগ্রেসের গৌরব গগৈ থেকে সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব। (Waqf Bill in Lok Sabha)


ওয়াকফ সংশোধনী বিলের সমালোচনায় অখিলেশ যাদব


ওয়াকফ বিলের বিরোধিতায় বক্তৃতা করতে উঠে এদিন কুম্ভমেলার প্রসঙ্গ টানেন অখিলেশ। তিনি বলেন, "কুম্ভমেলায় তো সকলের আস্থা জুড়ে ছিল। কুম্ভমেলা কিন্তু এবারই প্রথম হয়নি। কিন্তু বিজেপি এমন ভাবে প্রচার করল, যেন ১৪৪ বছর পর প্রথম মহাকুম্ভ হচ্ছে। মানুষও বেরিয়ে পড়লেন তা শুনে। সরকার জানাল, ১০০ কোটি মানুষ ধরার ব্যবস্থা কার হয়েছে কুম্ভে। কিন্তু ৩০ জনের প্রাণ গেল, তাঁদের নাম কী? ১০০০ জন হিন্দু নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। এখনও খোঁজ মেলেনি। তাঁদের তথ্য কোথায়?"


অখিলেশ আরও বলেন, "বিজেপি তখনই নতুন কোনও বিল আনে, তা ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা। বিজেপি মুসলিম ভাইদের ওয়াকফ সম্পত্তি চিহ্নিতকরণের কথা বলছেন, অথচ মহাকুম্ভে প্রাণ হারানো এবং হারিয়ে যাওয়া হিন্দুদের চিহ্নিতকরণের উপর পর্দা ঢাকা দিচ্ছে। বলছে, এতে কারবার বাড়বে। ধর্ম নিয়ে কারবার হতে পারে না। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও বলছেন কারবার হবে। কুম্ভ কি কারবারের জায়গা? মন্ত্রী বলছেন, জমি রেলের হোক বা সেনার, তা ভারতের জমি। অবশ্যই রেলের জমি ভারতের, সেনার জমিও ভারতের। কিন্তু সেনার জমি কি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে না? রেলের জমি কি বিক্রি হচ্ছে না? শুধু তাই নয়। ওয়াকফের জমির থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই জমি, যা চিন দখল করে নিয়েছে, গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু সেই নিয়ে যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে, তাই এসব বিল এনে নজর ঘোরানো হচ্ছে। আর মন্ত্রী নিজে যেখানকার বাসিন্দা (রিজিজু, অরুণাচল) সেখানে চিন কতটা জমি দখল করেছে বলুন।"


ওয়াকফ বিল নিয়ে অখিলেশ বলেন, "সরকার গ্যারান্টি দিক যে কারসাজি করে ওয়াকফ সম্পত্তি অন্য কারও হাতে তুলে দেওয়া হবে না। বলা হয়েছে পাঁচ বছরের ধর্মচারণ, জেলাশাসককে দিয়ে সমীক্ষা, বোর্ডে বাইরের লোকজনকে রাখার সিদ্ধান্ত, আসল উদ্দেশ্য একটাই, মুসলিম ভাইদের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে তাঁদের গুরুত্ব এবং নিয়ন্ত্রণকে কমিয়ে আনা। বলা হচ্ছে, উচ্চ আদালতে যাওয়া যাবে। আসলে দীর্ঘ সময় আইনি লড়াইয়ে আটকে রাখার ফন্দি। ওয়াকফ বিলের নীতি, উদ্দেশ্য, কোনওটাই ঠিক নয়। আসলে দেশের কোটি কোটি মানুষের বাড়ি, দোকান ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র। বিজেপি একটি অগণতান্ত্রিক দল। মতানৈক্যকেই শক্তি মনে করে। দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যখন বিরুদ্ধে, তার পরও এই বিল কেন? এটা আসলে বিজেপি-র রাজনৈতিক কৌশল, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নতুন রূপ, যা আপনাদের দংশন করবে। বাইরে লেখে সত্যমেব জয়তে, আসলে অসত্য কথা বলে। বিজেপি ওয়াকফ বিলের মাধ্যমে নিজের সেই সব সমর্থকদের তুষ্ট রাখতে যায়, যাঁরা অর্থনৈতিক নীতি, মূল্যবৃদ্ধিতে অসন্তুষ্ট হয়ে বিজেপি-র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বিজেপি-র ভোট কমে গিয়েছে। তাই ভোট বাড়ানোর পরিকল্পনাই এই বিল। ওয়াকফ সম্পত্তি হাতিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে নিজেদের লোকজনকে পাইয়ে দিতে চায়। জানে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে মুসলিমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি লাভবান হবে, বিভাজনের রাজনীতিতে সফল হবে।" এই বিল দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও মন্তব্য করেন অখিলেশ। শুধু তাই নয়, মুসলিম সমাজের মধ্যেও এখন বিজেপি বিভাজনের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন।


মোদি সরকারকে তীব্র আক্রমণ গৌরব গগৈয়ের


কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ কেন্দ্রকে 4D আক্রমণ শানান, ওয়াকফ বিলকে তিনি Dilute, Defame, Divide এবং Disenfranchise বলে উল্লেখ করেন তিনি। গৌরব বলেন, "সংখ্যালঘুদের প্রহার করে আসলে সংবিধানের উপর 4D আঘাত হানছে বিজেপি। সরকারকে ধর্মাচারণের সার্টিফিকেট কেন দিতে হবে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকে কি একই ভাবে সার্টিফিকেট চাইবে সরকার? বলছে পাঁচ বছর ইসলাম পালনের প্রমাম দিতে হবে। শুধু মুসলিমদের কেন ধর্মবিশ্বাসের সার্টিফিকেট দিতে হবে? কেন মানুষের ধর্মাবিশ্বাসে নাক গলাবে সরকার?"


কেন্দ্রে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি-র সরকার গঠিত না হলে দেশের সংসদভবনটিও ওয়াকফের হাতে চলে যেত বলে এদিন লোকসভায় দাবি করেন রিজিজু। সেই নিয়েও তাঁর তীব্র নিন্দা করেন গৌরব। সংসদে, গোটা দেশের সামনে যে দাবি করছেন রিজিজু, তার সাপেক্ষে প্রমাণ দিতে হবে তাঁকে, দাবি করেন গৌরব। সংসদে দাঁড়িয়ে একজন মিথ্যাচার করে চলেছেন, তার পরও কেন তাঁকে আটকানো হচ্ছে না, তা নিয়ে স্পিকার ওম বিড়লার দিকেও প্রশ্ন ছোড়েন গৌরব। সেই নিয়ে স্পিকারের সঙ্গে বাদানুবাদও হয় তাঁর। গৌরব জানান, ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে ২০২৩ সালে যৌথ সংসদীয় কমিটির বৈঠক হলেও, সেখানে বিল নিয়ে আলোচনা হয়নি। বরং ওয়েবসাইট কী ভাবে চালানো হয়, সেই নিয়ে একতরফা আলোচনা চালানো হয়। বিরোধীরা যে দাবি তুলেছিলেন, যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তার কিছুই কানে তোলেনি কেন্দ্র।


ওয়াকফ সংশোধনী বিলের মাধ্যমে মুসলিমদের উপকারের কথা যে বলছে কেন্দ্র, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন গৌরব। তাঁর বক্তব্য ছিল, "ওয়াকফ বিল সংশোধন আসলে নির্বাচনে বিজেপি-কে সুবিধা করে দেওয়ার চেষ্টা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে লঘু করে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে নিজেদের ভোটবাক্স ভরার চেষ্টা। বিজেপি শাসিত রাজ্যে রাস্তায় নমাজ পর্যন্ত পড়তে দেওয়া হয়নি মুসলিমদের। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অসম্মান করা হচ্ছে।"


ওয়াকফ বিল নিয়ে কেন্দ্রকে আক্রমণ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের


তৃণমূলের তরফে লোকসভায় এদিন ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরোধিতা করেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে এতদিন রাজ্যের যে ক্ষমতা ছিল, সংশোধনী বিলে সেটি খর্ব করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন তিনি। কল্যাণ বলেন, "এই বিলে মুসলিমদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এই ওয়াকফ সংশোধনী বিল অসাংবিধানিক। ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিমদের মেরুদণ্ড, পিছিয়ে থাকা শ্রেণিকে তারা সহযোগিতা জোগায়। বিলটি আইনে পরিণত হলে আরও ক্ষতি হবে। ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার।  এই বিল বৈধ আইনেরও পরিপন্থী।" কল্যাণ আরও বলেন, "তু হিন্দু বনেগা, না মুসলমান বনেগা, ইনসান কি অলাদ হ্যাঁ, ইনসান বনেগা। সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে। এই সংশোধনের কোনও পরিবর্তন ছিল না। আসলে মুসলিমদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট আগেই বেআইনি এবং অসাংবিধানিক বলেছিল। যা হচ্ছে, তা কোনও ভাবেই কাম্য নয়।"