উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়, কোচবিহার: কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-র হাতে তিনটি ফাইল। স্থানীয় বিজেপি নেতারা দিল্লিতে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের দাবি সনদ। বৃহস্পতিবার কোচবিহারে অমিত শাহ-র জনসভা কার্যত কল্পতরু মঞ্চ হয়ে গেল। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে তিনি যা যা ঘোষণা করলেন তা বোধহয় জেলার বিজেপি নেতারাও না দেখে একবারে বলতে পারবেন না।


কোচবিহার জেলার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলেও কোচবিহার কিন্তু তখনও ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ১৯৪৮ সালে রাজ্য হিসেবে ভারতের মানচিত্রে যুক্ত হয় কোচবিহার। কিন্তু রাজ্যের স্বীকৃতি না পেয়ে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেদিন থেকেই কোচবিহারকে রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনের সলতে পাকানো শুরু হয়। পরবর্তী ক্ষেত্রে 'গ্রেটার কোচবিহার'-এর দাবিতে অনন্ত রায়-এর নেতৃত্বে শুরু হয় আন্দোলন। ২০০৮ সালে কোচবিহার শহরে কার্যত হিংসাশ্রয় আন্দোলন শুরু হয়। এক পুলিশ কর্তার মৃত্যুর পর ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে প্রশাসন। অনন্ত রায় পালিয়ে যান। কিন্তু বংশীবদন বর্ম সহ গ্রেফতার হন বেশ কয়েকজন নেতা। জানা যায়, অসম থেকে এই আন্দোলনকে গ্রেটার কোচবিহারের দাবিতে সংগঠিত করতে থাকেন অনন্ত মহারাজ। কিন্তু এরই মধ্যে ভাগ হয়ে যায় তাঁদের সংগঠনের। আলাদা দল গঠন করেন বংশীবদনরা। নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তবে এখন বর্তমানে বংশীবদনের অনুগামীরা তৃণমূলের সঙ্গেই রয়েছেন।


আলোচনায় গ্রেটার কোচবিহারের আন্দোলনকে টেনে আনতে হল একটাই কারণে। তা হল, কোচবিহারে এই রাজবংশীয় ভোট একটা বড় ‘ডিসাইডিং ফ্যাক্টর’। যেকোনও দলই নির্বাচনের রণকৌশল যাই ঠিক করুক না কেন, ভোটের আগে রাজবংশীদের কথা ভাবতে বাধ্য হয়। যেমন বিজেপি সূত্রে খবর, কোচবিহারের সভায় আসার আগে আসামে অনন্ত রায়ের সঙ্গে দেখা করে আসেন অমিত শাহ। এদিনের সভায় হলুদ পতাকা হাতে যোগ দিয়েছিল গ্রেটার কোচবিহারের সর্মথকরা। পরিস্থিতি একসময় এমন হয় যে বিজেপি নেতাদের বলতে শোনা যায়, পতাকা সবাই নামিয়ে রাখুন। কারণ, হলুদ ঝড়ে গেরুয়া পতাকা কার্যত চোখেই পড়ছিল না। অমিত শাহ কোচবিহারের জন্য অসংখ্য প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন। টুরিস্ট স্পট, রাজবংশীদের সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, নারায়ণী সেনা যাদেরকে এক সময় তৈরি করেছিলেন অনন্ত রায়রা, তাদের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীতে আলাদা রেজিমেন্ট। ভোটে জিতে আসার পরই কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৮ হাজার টাকা। এরকম আরও অসংখ্য প্রতিশ্রুতি। লক্ষণীয় বিষয় হল, প্রতিশ্রুতি মূলত রাজবংশীদের ভোট মাথায় রেখে। কারণ কোচবিহারের সহজ পাটিগণিতের অংক হল, রাজবংশী ভোটব্যাঙ্ক যাদের দিকে থাকবে নির্বাচনের বৈতরণী পার করা ততই সহজ হবে।


সভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চড়া সুরে আক্রমণ করেছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। উন্নয়নের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যে একই সরকার, এই দমন ইঞ্জিন তথ্য আবার সামনে এনেছেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কেন্দ্র- রাজ্য সম্পর্কের যে বিন্যাস তাতে রাজনৈতিক বিভেদ কখনওই কাম্য নয়। অর্থাৎ রাজ্যে অন্য দলের সরকার থাকলে কেন্দ্র তাকে সাহায্য করবে না এমনটা হতে পারে না। কিন্তু এসব তথ্য গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বিজেপি, অভিযোগ বিরোধীদের। ' পরিবর্তন রথ'- এর সূচনা করেছেন। জয় শ্রীরাম স্লোগানে গলা ভিজিয়েছেন। 'দিদি-ভাইপো'-র নাম করে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির একাধিক অভিযোগ করেছেন। কিন্তু সারদা বা নারদা কাণ্ডে এখনও কেন চার্জশিট দিতে পারল না সিবিআই অথবা লোকসভার এথিক্সপন্থী কেন একবারও ডেকে পাঠালো না তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদদের? সে সব প্রশ্ন সযত্নে এড়িয়ে গেছেন।


আসলে আগামী তিন মাস সব রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে কখনও মনে হতে পারে ভোটের পরেই আপনি রাজা, নিজেকে আদানি-আম্বানিও মনে করতে পারেন। কিন্তু ভোটের পর ফানুস কীভাবে চুপসে যায় তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।