নয়াদিল্লি: নির্বাচনের মুখে ভোটার তালিকায় বিশেষ সংশোধন (Special Intensive Revision/SIR)। বিহারের পর পশ্চিমবঙ্গেও ভোটার তালিকা সংশোধন হবে বলে খবর। সেই নিয়ে এই মুহুর্তে উত্তাল দেশের রাজনীতি। বিহারে ইতিমধ্যেই ৫২ লক্ষ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে আসলে তলে তলে NRC হচ্ছে, বিজেপি-কে নির্বাচনে সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা। সেই নিয়ে সংসদে বিক্ষোভেও শামিল হয়েছেন বিরোধীরা। কিন্তু এই SIR আসলে কী? কাদের উদ্বেগের কারণ রয়েছে? জানুন বিশদে। (SIR Electoral Row)
Special Intensive Revision বা SIR আসলে কী?
ভোটার তালিকা সংশোধনের ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তথ্য় সংগ্রহের চল ছিল এতদিন। আগে থেকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যান প্রতিনিধিরা। নির্দিষ্ট সময়সীমাকে সামনে রেখে বৈধ ভোটার যাচাই করেন। আগের ভোটার তালিকা ত্রুটিপূর্ণ মনে হলে, নতুন করে ফের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি প্রতিনিধি পাঠিয়ে তথ্য জোগাড় করে নির্বাচন কমিশন। গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে বা সীমানা পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ার আওতায় এই পক্ষেপ করা হয়। (Special Intensive Revision)
নির্বাচন কমিশনের দাবি, সংবিধানের ৩২৪ নম্বর অনুচ্ছেদ তাদের ভোটারতালিকা সংশোধনের ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু বিরোধীদের দাবি, কমিশন সংবিধানের অপব্যাখ্যা করছে। কারণ সংবিধানের ৩২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করা রয়েছে। সংবিধানের ৩২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে, ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হয়েছে এমন প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার রয়েছে, যদি না অপরাধ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার দরুণ, মানসিক ভাবে অসুস্থ এবং দুর্নীতির জন্য তাঁদের সেই অধিকার বাতিল করা হয়।
হঠাৎ SIR-এর প্রয়োজন পড়ল কেন?’
কেন ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রয়োজন পড়ল, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গত ২৪ জুন নির্বাচন কমিশন জানায়, দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাপক হারে নতুন ভোটারের নাম যুক্ত হয়েছে ভোটার তালিকায়। বহু নাম বাদও গিয়েছে। এর ফলে গত ২০ বছরে দেশের ভোটারতালিকায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন চোখে পড়েছে। দ্রুতগতিতে নগরায়ন ঘটেছে দেশে। জীবন ও জীবিকার স্বার্থে যেভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছেন জনসংখ্যার বড় অংশ। কিন্তু অন্যত্র গিয়ে বাড়ি করলেও, আগের জায়গার ভোটার তালিকা থেকে নাম মোছেননি বহু মানুষ। বরং সেখানের ভোটার তালিকায় নতুন করে নাম তুলেছেন।
আগের ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়া থেকে SIR কেন আলাদা?
রেজিস্ট্রেশন অফ ইলেক্টর্স রুলস-এর ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে তিন ধরনের সংশোধনের কথা বলা হয়েছে— ইনটেনসিভলি বা সামারিলি, পার্টলি ইনটেনসিভলি অথবা পার্টলি সামারিলি। যেভাবে কমিশন বলবে। স্পেশাল সামারিলি রিভিশনের ক্ষেত্রে প্রতি বছরের শেষে দেশের সর্বত্র ভোটার তালিকায় সংশোধন ঘটানো যায়। বিধানসভা নির্বাচনের আগেও তা সম্পন্ন করতে পারে কমিশন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে কে মারা গিয়েছেন, কে পাকাপাকি ভাবে স্থান পরিবর্তন করেছেন, কার দুই জায়গায় নাম নথিভুক্ত রয়েছে, কার ভোটার কার্ড সংশোধন প্রয়োজন, সেই সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে গোটা বিষয়টি সম্পন্ন হয়। সেই মতো খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়।
ইনটেনসিভ রিভিশনের আওতায় নতুন করে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হয়, যা ১৯৫২ সালের পর থেকে ১৩ বার হয়েছে। এক্ষেত্রে বুথস্তরের আধিকারিকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করেন। বাড়ির কর্তার সই থাকে তাতে। বাড়তি নথিপত্র তখনই প্রয়োজন পড়ে, যদি অন্য দেশের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলের বাসিন্দা হন কেউ।
সেই নিরিখে বিহারের SIR একেবারে নতুন একটি পদ্ধতি, যা একেবারে আলাদা। এক্ষেত্রে নাগরিকত্ব প্রমাণ করার দায় ভোটারের কাঁধেই বর্তেছে। সেই সঙ্গে নিজেদের তৈরি আগের ভোটার তালিকার পবিত্রতাই আর মানছে না কমিশন।
গোটা দেশেই কি SIR হবে? বিহারের পর কি পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা সংশোধন করা হবে?
গত ২৪ জুন যে নির্দেশিকা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন, তার ১০ নম্বর প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে, সংবিধানের বিধান অনুযায়ী, ভোটার তালিকার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে গোটা দেশে SIR শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। লোকসভা নির্বাচনের পর বিহারেই যেহেতু বছর শেষে বিধানসভা নির্বাচন, তাই সেখানেই SIR চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেশের অন্যত্র কোথায়, কখন SIR হবে, সময় মতো তার নির্ঘণ্ট প্রকাশ করা হবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যে চিফ ইলেক্টোরাল অফিসার সর্বশেষ ভোটার তালিকা জমা দিতে শুরু করেছেন, শুরু হয়ে গিয়েছে প্রশিক্ষণও। কমিশনের কথা মতো যদি ক্রমান্বয়ে এগনো হয়, সেই নিরিখে বিহারের পর আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ, তার পর তামিলনাড়ু, অসম, কেরল, পুদুচ্চেরীতে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে।
SIR ঘিরে এত বিতর্ক কেন? বিরোধীরা কেন আপত্তি করছেন?
১৯৮৭ সালের পরে জন্ম হলে, নাগরিত্ব প্রমাণে নিজের এবং মা-বাবার যে ১২টি নথি জমা দেওয়ার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন, তাকে ঘিরেই বিতর্ক। অধিকাংশ মানুষের কাছেই সেই সব নথি নেই। ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে ফর্ম ৬এ ফিলআপ করে জমা দেওয়ার যে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়, তা নিয়েও সমস্যা। কারণ বহু মানুষ কর্মসূত্বে ভিন্ রাজ্যে থাকেন। তাঁদের পক্ষে এক অল্প সময়ের প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া সম্ভব নয়।
এতদিন যাঁরা লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিলেন, তাঁরা কি বেআইনি ভোটার হিসেবে গণ্য হবেন?
বুথস্তরের আধিকারিক বা অনলাইন মাধ্যমে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে ফর্ম ৬এ জমা না দিলে, ভোটারতালিকা থেকে নাম বাদ যেতে পারে বলে জানানো হয়েছে বিহারে। ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যাঁরা সমস্ত নথি জমা দিতে না পারবেন, তাঁদেরও নাম বাদ যেতে পারে।
নিজেকে বৈধ নাগরিক প্রমাণ করতে, SIR-এর জন্য কী কী নথি প্রয়োজন?
১) যে কোনও পরিচয়পত্র/পেনশনের কাগজ/রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার বা রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থার কর্মী হলে পেনশনের নথি।
২) ১৯৮৭ সালের আগে ভারত সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, LIC, রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থার দেওয়া পরিচয়পত্র, সার্টিফিকেট বা অন্য নথি।
৩) বৈধ জন্মের শংসাপত্র।
৪) পাসপোর্ট।
৫) মাধ্যমিক বা সরকার স্বীকৃত বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শংসাপত্র।
৬) সংশ্লিষ্ট রাজ্যের স্থায়ী ঠিকানার নথি।
৭) অরণ্যের অধিকারের শংসাপত্র।
৮) OBC/SC/ST বা অন্য যে কোনও জাতির বৈধ শংসাপত্র।
৯) NRC-র নথি থাকলে (যে রাজ্যে হয়ে থাকবে)
১০) রাজ্য বা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে পরিবারের নথিভুক্তির নথি।
১১) জমি বা বাড়ির সরকারি নথি।
১২) ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় নাম থাকলে, তার প্রতিলিপি।
বিহারের ক্ষেত্রে পরে যদিও নিয়ম শিথিল করা হয়। ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় নাম থাকার নথি থাকলেই, আর কিছু লাগবে না বলে জানায় কমিশন।
সুপ্রিম কোর্ট প্রমাণপত্র হিসেবে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড এবং রেশন কার্ড করতে বলেছিল কমিশনকে। সেগুলি কি বৈধ ভোটার হওয়ার প্রমাণপত্র হিসেবে গ্রাহ্য হবে?
সোমবার সুপ্রিম কোর্টে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, বৈধ ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে আধার, ভোটার বা রেশন কার্ড মাপকাঠি হিসেবে গণ্য হবে না। নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়ার অধিকার কমিশনের আছে বলে শীর্ষ আদালতে জানায় তারা। তবে নাগরিকত্ব প্রমাণে নথি জমা করতে না পারলে, কারও নাগরিকত্ব বাতিল হবে না বলেও আদালতে জানিয়েছে কমিশন। বলা হয়েছে, তাদের লক্ষ্য শুধু ভোটার তালিকার পবিত্রতা রক্ষা করা।
তথ্যসূত্র - নির্বাচন কমিশন