চলতি মাসের ১ তারিখ কার্যত নীরবেই চলে গেলেন এনুগা শ্রীনিবাস রেড্ডি। খুব বেশি লোক হয়তো শোনেননি তাঁর কথা, কিন্তু গোটা বিশ্ব জুড়ে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে পদ্মশ্রী ইএস রেড্ডির অবিরত লড়াই চিরউজ্জ্বল হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। বিশ্বজুড়ে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছেন তারা ছাড়াও একাধিক গান্ধীবাদী পণ্ডিতরা চেনেন রাষ্ট্রপুঞ্জের দীর্ঘদিনের এই দুঁদে অথচ আবেগপ্রবণ-প্রভাবশালী কূটনীতিবিদকে।


দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সাইরিল রামাফোসা তাঁর শোকবার্তায় ইএস রেড্ডির প্রশংসা করে বলেছেন, ‘মানবাধিকার রক্ষার ব্রত নিয়ে লড়াই করে গিয়েছেন আজীবন। তবে তার থেকেও সামাজিক সংহতি প্রতীক হিসেবে তাঁকে মনে রাখব সকলে।’ সামাজিক সংহতি রক্ষার বিষয়ে শুধু ভারতই নয়, গোটা বিশ্বই সমস্যার সামনে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দুর্ভাগ্যবশত সেভাবে সামনে আসেনি ১৯২৫ সালে দক্ষিণ ভারতে জন্মানো রেড্ডির। শুধুমাত্র ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ জানিয়েছেন তাঁর শোকবার্তা।

২০১৩ সালে গুহ-র লেখা দ্য ফার্স্ট ভলিউমে (২০১৩) তিনি লিখেছিলেন, ‘ভারতীয় দেশপ্রেমিক, দক্ষিণ আফ্রিকান কূটনীতিবিদ আর বিশ্বের সব দেশে ছড়িয়ে থাকা গান্ধীবাদী পণ্ডিতদের বন্ধু ইএস রেড্ডি।’ দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি পরিচিত কমরেড রেড্ডি হিসেবেই। যে নামে তাঁকে ডাকত আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস। গোটা বিশ্বজুড়ে তাঁর কাজের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে থাকলেও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যের লম্বা লড়াইয়ে তাঁর নেওয়া ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।

নেলসন ও উইনি ম্যান্ডেলা, অ্যালবার্ট লুথালি, অলিভার টাম্বো, বিল্লি নায়ারের মতো খ্যাতিমানদের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় একইসঙ্গে উচ্চারিত হয়ে থাকে ইএস রেড্ডির নাম।  আধুনিক বিশ্বের দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল তাঁর। দুদশক ধরে রাষ্ট্রপুঞ্জের দায়িত্বে থাকার সময় যে লড়াই চালান তিনি। রাষ্ট্রপুঞ্জের বর্ণবৈষম্যবিরোধী স্পেশাল কমিটির প্রধান সচিব ও পরে রাষ্ট্রপুঞ্জের বর্ণবৈষম্যবিরোধী ইউএন সেন্টারের ডিরেক্টর হিসেবে মোট দু'দশক দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন ইএস রেড্ডি। আগামী দিনগুলিতে তাঁর কাজের পরিধি নিয়ে বিশ্বজুড়ে অনেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে তা নথিবদ্ধ করে রাখার কাজ করবেন বলেই আশা রাখি।

ইএস রেড্ডির সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য কখনও হয়নি। কিন্তু স্নাতক পড়ার সময় ১৯৮০তে ইউএন সেন্টারের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দলিল তথা বিভিন্ন লেখার সংকলন পেতে ও পড়তে শুরু করি। আশির দশকে মাঝামাঝি তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে দায়িত্বে অব্যাহতি নিলেও গোটা দশকজুড়ে বেরনো ‘নোটস অ্যান্ড ডকুমেন্টস’এ বারবার পরিলক্ষিত হয়েছে তাঁর উজ্জ্বল প্রভাব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোক বা তাঁর নিজের জন্মভিটে ভারতের প্রচেষ্টা, দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বমঞ্চে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সব চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন ইএস রেড্ডি। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন হয়। ১৯৫৩ সালে কমিউনিস্টদের বিপজ্জনক কাজকর্মে সহায়তার অভিযোগে রেড্ডির সংস্থার কাজে বাধা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু দমানো যায়নি তাঁকে।

১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে ইউএন পাবলিকেশনের ২৫তম বর্ষপূর্তিতে বক্তব্য রাখার সময় রেড্ডি বলেছিলেন, ‘বর্ণবৈষম্য রুখতে, ন্যায়-সাম্য স্থাপন করার লক্ষ্যে যখন স্পেশাল কমিটি গঠিত হয় তখন পাশ্চাত্যের কোনও দেশ এগিয়ে আসেনি।’ দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর বর্ণবৈষম্য বিরোধী লড়াইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী শন ম্যাকব্রিড। ১৯৮৫ সালে বক্তব্য রাখার সময় ম্যাকব্রিড বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যেরকম অবদান উনি রেখেছিলেন, তেমনই রাষ্ট্রপুঞ্জের আর কেউ করেননি।’

১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পরও ইএস রেড্ডি ছিলেন সেখানকার সহকারী মহাসচিব পদে। যে সময় তিনি মহাত্মা গান্ধীর পথ অনুসরণ করে শুরু করেছিলেন বিশ্বজুড়ে সাম্য-ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্টার লড়াই। মাদ্রাস থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তরে জন্মানো ইএস রেড্ডি একসময় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তাঁর বাবা-মা-র স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদানের কথা। ভারতে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার লড়াইয়ে তাঁর মা অর্থ জুগিয়েছিলেন নিজের গহনা বিক্রি করে। ভারতে যেমন ন্যায়ের লড়াই ছিল তাঁর পরিচয় তেমনই গান্ধীজির দক্ষিণ আফ্রিকায় সাম্যের জন্য লড়াই গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল রেড্ডির মনে।

১৯৯৩ সালে ইন্ডিয়ান সাউথ আফ্রিকানস ইন স্ট্রাগল ফর ন্যাশনাল লিবারেশন বইতে তিনি গান্ধীজির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য-সম্মান বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছিলেন। যেখানে অন্যায়ের শিকার হওয়া মানুষদের প্রতি ভারতীয়দের লড়াইয়ের কথা জানাতে কুখ্যাত ট্রেসন ট্রায়ালের (ডিসেম্বর ১৯৫৬-১৯৬১) উল্লেখ করে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন মোলভি আসমাইল আহমাদ কাচালিয়ার অবদানগুলি।

গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর সঙ্গে একযোগে গান্ধী অ্যান্ড সাউথ আফ্রিকা ১৯১৪-১৯৪৮ বই প্রকাশ করে বিস্তারিতভাবে গান্ধীজির আফ্রিকার দেশে কাজকর্মের হদিশ দিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে সেখানে বর্ণবৈষম্য ও সাম্যের জন্য গান্ধীজি যে লড়াই প্রায় দু'দশক করেছিলেন, সেটাই ভারতের মাটিতে তাঁর অবিস্মরণীয় পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল বলেই মনে করেন তিনি। গান্ধীজির দ্বিতীয় সন্তান মনিলালের দক্ষিণ আফ্রিকায় থেকে যাওয়া ও কাজকর্মেরও উল্লেখ রয়েছে যেখানে।

ভারতে ফেরার বছর পাঁচেকের মধ্যে গান্ধীজি হয়ে উঠেছিলেন মহাত্মা। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়লেও সেদেশের মানুষ সবসময় তাঁকে স্মরণে রেখেছেন বলেও জানান তিনি। গান্ধীজিও কিন্তু মনে রেখেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে। আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারানোর দুদিন আগে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ২৮ জানুয়ারি এক আলোচনায় গান্ধীজিকে তুলে ধরেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রসঙ্গ। তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনের ২০টা  বছর কাটিয়েছি দক্ষিণ আফ্রিকায়। তাই দেশটাকে আমি নিজের দেশ বলতেই পারি।’

রেড্ডি ও গোপাল গান্ধীর বই থেকেই জানা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার সাম্যের লড়াইয়ের অপর দুই প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব ও ট্রান্সভাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর ইউসুফ ডাডু ও ডক্টর মন্টি নাইকেরের সঙ্গে ১৯৪৭ সালের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেছিলেন। গান্ধীজী তাদের বলেছিলেন, ‘এশিয়া এশিয়ানদের জন্য বা আফ্রিকা আফ্রিকানদের জন্য এই সব স্লোগানে এখন বিশ্ব ঐক্য আটকে রাখা ঠিক নয়, এখন গোটা বিশ্বের সময় এসেছে বিশ্বজুড়ে অন্যায়-অবিচারের শিকার যারা হয়েছে তাদের পাশে দাঁড়ানোর।’

গান্ধীজিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর ন্যায়-সাম্যের প্রতি লড়াইয়ে ভারতীয়দের যে নতুন দিক বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন, সেই ধারাকেই বয়ে নিয়ে এগিয়েছিলেন ইএস রেড্ডি। বিভিন্ন সংকীর্ণতার আবহে যখন ভারত সহ গোটা বিশ্ব এখনও দীর্ন, সেই সময় ন্যায়-সাম্য-বিচারের জন্য আজীবন লড়াই করে যাওয়া ইএস রেড্ডির কাজের অবদান ও গুরুত্ব আরও উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে থাকা উচিত।

দ্রষ্টব্য- এই নিবন্ধ লেখকের ব্যক্তিগত মতপ্রকাশ। যার সঙ্গে এবিপি আনন্দের সম্পাদকীয় নীতির কোনও সম্পর্ক নেই।