নয়াদিল্লি: দীর্ঘ আলাপআলোচনার পর চিনকে হামবানতোতা বন্দর লিজ দেওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করল শ্রীলঙ্কা। তবে শ্রীলঙ্কা চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই ভারতকে আশ্বস্ত করেছে যে, এই বন্দর চিন সামরিক উদ্দেশে ব্যবহার করতে পারবে না। বন্দরে চিনের কার্যকলাপ হবে বাণিজ্যিক। ভারতকে এই আশ্বাস দেওয়ার পরই ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বক্ষরিত হয়েছে।


ভারতের উদ্বেগের কথা মাথায় রেখে শ্রীলঙ্কা চুক্তির খসড়া নতুন করে তৈরি করেছে। নয়া চুক্তিতে হামবানতোতা বন্দরের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার মতামতের গুরুত্ব আরও বাড়ানো হয়েছে। দীর্ঘ কয়েকমাস ধরে আলোচনা এবং শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরোধিতার কারণে এতদিন এই চুক্তি স্বাক্ষরের কাজ আটকে ছিল।

ভারত মহাসাগরের তীরে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের হামবানতোতা বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র গড়ে তুলেছে। গত কয়েক বছর ধরেই ওই বন্দরটি পেতে চাইছিল চিন।

শ্রীলঙ্কার বন্দর কর্তৃপক্ষ (এসএলপিএ) এবং চিনের ম্যার্চেন্ট পোর্ট হোল্ডিংসের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে বলেছেন, কোনও ঋণ ছাড়াই এই চুক্তি দেশের পক্ষে লাভজনক। এই চুক্তির ফলে বন্দর তৈরির জন্য যে বিদেশি ঋণ হয়েছিল, তা শোধ করা যাবে।

অন্যদিকে, চিনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর)-এর ক্ষেত্রে এই হামবানতোতা বন্দর গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র। চিন ও ইউরোপের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও শহরগুলির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ওবিওআর-কে চিন নয়া সিল্ক রুট হিসেবে উল্লেখ করে।

চিন হামবানতোতা বন্দরকে ভারত মহাসাগরে নিজেদের আরও একটি নৌঘাঁটি হিসেবে গড়তে উদগ্রীব ছিল। সম্প্রতি ভারত মহাসাগরের এডেন উপসাগরে ডিজিব্যুটিতে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে চিন।

চিনের এই আগ্রহ সম্পর্কে প্রথম থেকেই নিজেদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগের কথা শ্রীলঙ্কাকে জানিয়ে এসেছে ভারত। এর জবাবে শ্রীলঙ্কা জানিয়েছে যে, হামবানতোতা বন্দরকে চিনের সামরিক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে না।

চুক্তির খসড়া তৈরির সময় সামরিক ব্যবহারের বিষয়টি শ্রীলঙ্কা ও চিনের মধ্যে আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এর ফলে চুক্তিটি স্বাক্ষরে দেরী হয়। চুক্তির শর্ত সংশোধিত হয়েছে এবং নয়া চুক্তি অনুযায়ী, বন্দরে চিনের শেয়ার ৭০ শতাংশ এবং বন্দরটি শুধুমাত্র বাণিজ্যিক কাজেই ব্যবহৃত হবে।

২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই রাস্তা, বিমানবন্দর, বন্দর তৈরির জন্য চিন থেকে কোটি কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। হামবানতোতা বন্দর তৈরির ভার চিনা সংস্থাকে দিয়ে সেই ঋণের কিছুটা শোধ করতে চাইছে শ্রীলঙ্কা সরকার। ঋণশোধে শ্রীলঙ্কার অপারগতার বিষয়টি কাজে লাগিয়ে মায়ানমার ও পাকিস্তানে যে সুবিধা তারা পেয়েছে সেই একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এক্ষেত্রেও ঘটাতে চেয়েছিল চিন।

যদিও শ্রীলঙ্কা সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, তাদের নৌবাহিনীই হামবানতোতা বন্দরের নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকবে। কোনও বিদেশী বাহিনীকে এই বন্দর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।

হামবানতোতা বন্দরে চিনের নজর পড়ার পর থেকেই শ্রীলঙ্কা ও চিনের মধ্যে চুক্তির বিষয়ে সতর্ক মনোভাব গ্রহণ করেছে ভারত।

ভারত মহাসাগরে স্থিতাবস্থার যে কোনও ধরনের পরিবর্তনে ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ স্বাভাবিক। আবার সেই বদল যদি হয় চিনের কারণে, তাহলে তো আর কথাই নেই। ২০১৪-তে এই বন্দরে যখন চিনা সাবমেরিন নোঙর করেছিল, তখন প্রসঙ্গটি শ্রীলঙ্কার কাছে তুলেছিল।

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন স্তরে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আলোচনা চলে ভারতের। ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগের কথা মাথায় রেখেই গত মার্চে হামবানতোতা বন্দরে চিনের সাবমেরিন নোঙর করার অনুরোধ খারিজ কর দেয় শ্রীলঙ্কা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে ভারত ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান একই। কাজেই হামবানতোতা বন্দর চুক্তি নিয়ে ভারতের সে রকম উদ্বেগের কারণ নেই। কিন্তু ভারত মহাসাগরে চিনের ক্রমবর্দ্ধমান উপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি ভারতের হাল্কাভাবে নেওয়ারও কিছু নেই। সময় সুযোগ এলে চিন যে কোনও নীতির ধার ধারবে না, তা দক্ষিণ চিন সাগরের ঘটনা থেকেই স্পষ্ট।