কলকাতা: ইতিহাসের পাতা থেকে রোজনামচায় জায়গা করে নিয়েছে অতিমারি। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী নয় শুধু, তার সঙ্গে যুঝছে গোটা বিশ্ব। লক্ষ লক্ষ মানুষের অস্তিত্ব মুছে গিয়েছে নিমেষে। পরিপাটি হোক বা এলোমেলো, জীবন খাতার সব হিসেবে এই তিন বছরে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে (Deaths in 2022)। ২০২০, ২০২১-এর পর ২০২২ সালেও লাভ-লোকসানের অঙ্ক মেলানো যাচ্ছে না। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রিয়জন তো বটেই, দেশের-দশের অভিভাবক, স্বনামধন্য, চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বদেরও হারাতে হয়েছে এ বছর। নতুন বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দেশ-বিদেশের এমনই কয়েক জন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বকে ফিরে দেখার সন্ধি ক্ষণ হাজির (Year Ender 2022)।


রাহুল বাজাজ


পেট চালাতে জুতোর শুখতলা খুইয়ে ফেলা মধ্যবিত্তের জীবনে দু’চাকার স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছিলেন তিনি। বছরের গোড়াতেই, ১২ ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাজাজ গোষ্ঠীর প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা বিশিষ্ট শিল্পপতি রাহুল বাজাজ (Rahul Bajaj_। ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত রাহুল বাজাজের বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। অসুস্থতাও কাবু করে ফেলেছিল শরীরকে। লেনদেনের কারবার  করলেও, মনুষ্যত্বের সঙ্গে কখনও আপস করেননি রাহুল বাজাজ। ভোলেননি মানবিক কর্তব্য। তাই ভরাসভায় চোখে চোখ রেখে সরকারকে প্রশ্ন করার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন শেষ বয়সেও।


রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা


গোটা আকাশকেই মধ্যবিত্তের নাগালে আনতে চেয়েছিলেন। স্বল্প খরচে সাধারণ মানুষকে বিমানযাত্রার সুযোগ করে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। সেই স্বপ্নের উড়ানের বাস্তবায়ন হওয়ার ঠিক আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হল শিল্পপতি রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালাকে (Rakesh Jhunjhunwala)। কলেজে পড়ার সময় মাত্র ৪৩ টাকায় প্রথম শেয়ার কেনা। সেই থেকে একদিনে ৮৭৫ কোটি আয় করে নজির গড়েন। আয়কর আধিকারিকের ছেলে রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা হয়ে ওঠেন শেয়ার বাজারের ‘বিগ বুল’। ২২ অগাস্ট প্রয়াত হন তিনি।


অভিজিৎ সেন


শহরের চাকচিক্য যতই দৃষ্টিমধুর হোক না কেন, ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড যে গ্রাম, তা ঢের আগে টের পেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে পাথেয় করেই গ্রামোন্নয়নে উৎসর্গ করেছিলেন জীবন। অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ সেন (Abhijit Sen)। প্রবাসী বাঙালির জন্ম বিহারে। ২০০৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য ছিলেন। কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অধিকার প্রদানের নেপথ্যে ছিলেন। পেয়েছিলেন ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান। ২৯ অগাস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।


পালোনজি সাপুরজি মিস্ত্রি


মায়ানগরীর অর্ধেক গড়ে ওঠে তাঁর হাতেই। বিদেশিনী স্ত্রীর জন্য আয়ারল্যান্ডের নাগরিকত্ব পর্যন্ত গ্রহণ করতে পিছপা হননি পালোনজি সাপুরজি মিস্ত্রি (Pallonji Mistry)। মুম্বইয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার দফতর থেকে ঘানার রাষ্ট্রপতির দফতর, মাস্কটের সুলতানের প্রাসাদের নির্মাণ পর্যন্ত তাঁর হাতেই হয়। শিল্প সংস্থা টাটার ১৮ শতাংশেরও বেশি শেয়ারের মালিক ছিলেন। ২৭ জুন ৯৩ বছর বয়সে প্রয়াত হন। পেয়েছিলেন ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান।


সাইরাস মিস্ত্রি


পালোনজি সাপুরজি মিস্ত্রির ছেলে। বাবার দেখানো পথেই হাঁটেন। সাফল্য যেমন পেয়েছেন, তেমনই সাইরাস মিস্ত্রি (Cyrus Mistry) ওঠাপড়াও দেখেছেন বিস্তর। টাটা-র কর্তৃত্ব হাতে পেয়েও হারাতে হয়। রতন টাটা খোদ হাতে ধরে বুঝিয়েছিলেন দায়-দায়িত্ব। কিন্তু মানসপুত্র হতে হতেও, বিতর্কিত থেকে যায় যাত্রা। পুরনো সমীকরণ আর ফেরেনি কখনও। ৪ সেপ্টেম্বর গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুতেও পড়ে যায় আলোড়ন।


এলা ভট্ট


না বাপের বাড়ি, না শ্বশুরবাড়ি, মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলার প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিলেন ঢের আগেই। তাই বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মহিলা পরিচালিত সমবায় এবং ট্রেড ইউনিয়ন ‘সেবা’র প্রতিষ্ঠা করেন গান্ধীবাদী এলা ভট্ট (Ela Bhatt)। প্রান্তিক মেয়েদের রোজগারের রাস্তা দেখিয়েছিলেন। ৮৯ বছর বয়সে ২ নভেম্বর প্রয়াত হন। ‘পদ্মভূষণ’ ছাড়াও ‘র‍্যামন ম্যাগসেস’ সম্মান পান।


মুলায়ম সিংহ যাদব


কুস্তির আখড়ায় গেলে চামড়ার পাশাপাশি মাথাও মোটা হয়ে যায় বলে ধারণা ছিল। কিন্তু কুস্তির আখড়ায় প্রতিপক্ষকে আছাড় মারার পাশাপাশি, নিজেকে ঘষামাজার কাজও সমান তালে চালিয়ে যান উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সমাজবাদী পার্টির কুলপতি মুলায়ম সিংহ যাদব (Mulayam Singh Yadav)। রাজনীতির মারপ্যাঁচ শিখে নিয়েছিলেন অল্প বয়সেই, যা বিরোধীদের কুপোকাত করতে কাজে লাগিয়েছেন বার বার। অনগ্রসর পরিবারের ছেলে জরুরি অবস্থায় জেল খাটেন। তিন-তিন বার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন। কেন্দ্রে প্রতিরক্ষামন্ত্রীও ছিলেন। হিন্দি বলয়ের জাতপাতভিত্তিক রাজনীতির খণ্ডকরণ ঘটান। তাঁর আমলে অযোধ্যায় মসজিদের কাঠামো রুখতে গুলিও চালায় পুলিশ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার জন্য মাথা নোয়াননি। মারা যান ১০ অক্টোবর।  


মিখাইল গর্বাচভ


পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট। ১৯৯১ সালে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’র অবসানের নেপথ্য নায়ক হিসেবে বিবেচিত হন আজও। যুদ্ধোত্তর বিশ্বকে শান্তির রাস্তা দেখিয়েছিলেন মিখাইল গর্বাচভ (Mikhail Gorbachev)। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে সমাজতন্ত্রে ইবিশ্বাস ছিল বরাবর। কৃষক পরিবারের ছেলে,বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করার অভিজ্ঞতা চিল। তাই পুঁজিবাদকে হটিয়ে সংস্কার করতে চেয়েছিলেন অর্থনীতির। কিন্তু নিজের দেশেই ‘ঘরশত্রু’ হয়ে ওঠেন। নোবেল পুরস্কার পেলেও, নিজের দেশের মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা হারাতে হয়। ৩০ অগাস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


জঁ লুক-গোদার


চলচ্চিত্র নেহাত বিনোদনের মাধ্যম নয়, সমাজের আয়না, তা বুঝিয়েছিলেন ফরাসি-সুইস পরিচালক জঁ-লুক গোদার (Jean-Luc Godard)। ফ্রান্সের নবকল্লোল চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, আধুনিক, শিল্পমনস্ক মানুষের কাছে খোদই সাম্যবাদের নায়ক হয়ে ওঠেন। তার জন্য সরকারের চোখে হয়ে ওঠেন ‘মাওবাদী’। নিজের ছবিতে রক্তমাংসের বাস্তব গড়ে তুলতেন গোদার, সংলাপ ও দৃশ্যের মেলবন্ধনে লিখতেন ভাবনার অভিধান। বিংশ শতকের অন্যতম সেরা পরিচালক নন শুধু, চিন্তাশীল সমাজের পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন। ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যান।